ফজলুল বারী: সাংবাদিক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক
গত সপ্তাহে পূঁজিবাজারে ঋণাত্মক পরিবর্তন ঘটানো হয়। এটাকে ‘কারেকশন’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। শব্দটি আরোপিত। বাজার সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী অংশের সাফাই উক্তি। সংবাদ মাধ্যমও এসব সাফাই উক্তি বহন করছে। প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন; মাত্র দুই‘শ পয়েন্ট সূচক বৃদ্ধি এবং দিনের লেনদেন অংক এক হাজার কোটি টাকার ঘরে উঠা কী ভুল ছিল? যদি তাই হয়-পূঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালন ব্যয় উঠাবে কী ভাবে? লেগে থাকা বিনিয়োগকারীদে গত ১৫ বছরের পুঁঞ্জীভূত লোকসান ‘উসুল’ হবে কীভাবে? কী ভাবে লাভের মুখ দেখবে তারা? আসলে পূঁটি মাছের আত্মা নিয়ে পুঁজির সাগরে সাতার কাটা যায় না।
বিনিয়োগ তত্ত্ব, “হোপ, ফিয়ার আ্যন্ড গ্রীড” (এইচএফজি)। পূঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রেও একই তত্ব প্রযোজ্য। প্রমাণিত সত্য হলো,‘মার্জিন ক্যান্সার’ পূঁজিবাজারের শত্রু। ২০ থেকে ২২ শতাংশ হারে সুদ নিয়ে মাঝারি মেয়াদের বিনিয়োগও সম্ভব না। মার্জিন সুদ ছুটির দিনসহ যুক্ত হতে থাকে। তাই ‘টি টুয়েন্টি স্টাইলের’ ‘টি প্লাস টু’ নির্ভর জুয়াই তাদের পছন্দ । কয়েকটি বড় ব্যাংক প্রাতিষ্ঠানের ব্রোকার হাউস পুঁজিবাজারকে ‘ক্যাসিনো’ বানিয়েছে।পূঁজিবাজারের ক্যাসিনোর কারবারিদের প্রধান আয় উচ্চ সুদ। ‘ক্যাসিনো’র কারণেই মার্জিন ও নন মার্জিন উভয় ধরণের বিনিয়োগকারীগণ ক্ষতিগ্রসস্ত হয়। পূঁজি হারিয়ে নি:স্ব হয়ে বাজার ছাড়তে বাধ্য হয়।
পরিসংখ্যন অনুযায়ী, গত ১০ বছরে ১৮ লাখ ৩৭ হাজার বিনিয়োগকারী এ বাজার ছাড়তে বাধ্য হয়। ২০১৫ সালে পূঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল ৩২ লাখ ৪ হাজার। বর্তমানে আছে ১৩ লাখ ৬৯ হাজার।
বিএসইসি’র পরিসংখ্যন; বর্তমানে ৫০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগকারী ৭০ জন। ৫০ কোটি টাকার উপরে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ৭৩৩ জন। এই দুই শ্রেণীর বিনিয়োগকারী সংখ্যা ৮০৩। এই ৮০৩ জন ছাড়া বাকী ১৩ লাখ ৬৮ হাাজর ৯৩০ জন বিনিয়োগকারীই উচ্চ ঝুঁকির আওতায় আছে । ‘ক্যাসিনো সিন্ডিকেট’ সবার পুঁজি খাবে।খাদকরা ‘স্যালামান্ডার’ প্রজাতীর উভচর প্রাণী। নিজ শরীরের অংশও খায়। ক্যাসিনো চক্রও নিজ হাউসসহ অন্যান্য হাউসের বিনিয়োগকারীদের পুঁজিও খাচ্ছে।

২০১০ সালে বাজারের ধসের মূল কারণ ছিল মার্জিন। মার্জিনসৃষ্ট এক্সপোজার সীমা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক পুঁজিবাজারে ধস নামায়। ১৯৯৬ ধসের প্রধান কারণ ছিল কাগজের শেয়ার সার্টিফিকেট এবং সালামান গং।
গত দু’সপ্তাহে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন মৌল অবস্থানে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর ও মাস ঘোষণা করেছে সরকার।এসময় সামষ্টিক অর্থনীতিতে কয়েকটি ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ আ্যন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) প্রতিমন্ত্রীর মর্যদায় আসীন ডক্টর আনিসুজ্জামান চৌধুরী গত সপ্তাহে,ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের চারজন শেয়ার হোল্ডার পরিচালকের সাথে বৈঠক করেছেন। সে বৈঠক থেকে বেশ কিছু সমস্যার সমাধানের সবুজ সংকেত মিলেছে।
তিনি ডিএসই পরিচালদের বলেন; “আপনারা যা যা চান? তা লিখিত আকারে দিন। কেন চান? এর সুবধিা অসুবিধা সব উল্লেখ করবেন। আমার এখতিয়ারে আছে এমন সব সমস্যার দ্রুত সমাধান দিবো। এখতিয়ারের বাইরেরগুলো একটু দেরি হতে পারে । উল্লিখিত যেকোন একটি কারণই ডিএসইএক্স সূচক ১০০ থেকে ২০০ পয়েন্ট বাড়াতে পারতো। ডিএসই’র লেনদেন অংক দুই থেকে তিন হাজার কোটি টাকায়ও উন্নীত করতে পারতো। কোনটাই ঘটেনি! ‘ক্যাসিনো সিন্ডিকেট’ও পরস্পরের প্রতি পরস্পরের অবিশ্বাস ধারণ করে। এ অবিশ্বাসই সূচক হ্রাস অনিবার্য করে। টেকনিক্যাল এনালিস্টদের বরাত দিয়ে বাজারে গুঞ্জণ ছড়ানো হয় ডিএসইএক্স সূচক ৫৮০০ পয়েন্টের ঘরে গেলে গতি থামাবে। পিছিয়ে আবারও সামনে এগুবে। আশঙ্কার যায়গা থেকেই সিন্ডিকেট ভুক্তরাও প্রতিশ্রুত অবস্থানে যাবার আগেই প্রফিট গ্রহন করে। তাতেই বিপত্তি ঘটে।
গত সপ্তাহের লেনদেন চিত্রে বেশ কয়েকটি ইতিবাচক সংকেতও যুক্ত হয়েছে। বহুদিন পর লেনদেনের শীর্ষ দশ তালিকায় সবকটি ‘এ’ শ্রেণীভুক্ত কোম্পানির শেয়ারের স্থান পেয়েছে । মূল্য বৃদ্ধির শীর্ষ দশ তালিকার ৭টি ‘এ’ শ্রেণী ভুক্ত কোম্পানির শেয়ার ছিল । ‘জেড’ শ্রেণীর ২টি ও একটি ‘বি’ শ্রেণীভুক্ত কোম্পানির শেয়ার স্থান পায়। খাত ভিত্তিক পরিসংখ্যানে ২১টির মধ্যে ১৬ খাতের সিকিউরিটিজে সবুজ সংকেত ছিল। ৪ খাতে লাল সংকেত। লেনদেনের ক্ষেত্রে ১৭ খাতের সিকিউরিটিজে সবুজ ও ৪ খাতে সিকিউরিটিজে লাল সংকেত দৃশ্যমান হয়। সেক্টর ওয়াইজ রিটার্ন ডিসট্রিবিউশনে, সুবুজ ৭ খাতে। লাল ১৪ খাতে। মার্কেট পিই ১০.৪১ । পিই বিবেচনায় ২০ পিই’র নীচে ২১ খাতের সিকিউরিটিজ। ৫ খাতের পিই ২০ এর উপরে।
সামিগ্রিক বাজারচিত্র ক্রয়ানুকুল। সাম্প্রতিক বাজার চিত্রে সূক্ষ্ম কারসাজির চিত্রও দৃশ্যমান হয়েছে ।গত সপ্তাহের প্রথম দিন, ধনাত্মক ধারায় লেনদেন কর্মকাণ্ড শুরু হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সিটি ব্যাংকের শেয়ারের দিয়ে আগ্রাসী সেল টুলস প্রয়োগ করে ঊর্ধমুখী সূচক নিম্নগামী করা হয়। পরে গ্রামীণের শেয়ার দিয়ে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করা হয়। সামগ্রিক বাজার চিত্রে ব্লুচিপস শেয়ার সংগ্রহ প্রবনতাও লক্ষ্যণীয়।


















