ঢাকা, সোমবার, ৪ অগাস্ট ২০২৫, ১২:৫৭ অপরাহ্ন

২ বছর ধরে উৎপাদন বন্ধ নিউ লাইনের, জানে না ডিএসই

নিজস্ব প্রতিবেদক

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত টেক্সটাইল খাতের কোম্পানি নিউ লাইন ক্লোথিংস লিমিটেডের প্রায় দুই বছর ধরে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। অথচএ সম্পর্কে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-ডিএসই কিছুই জানেনা। আর কোম্পানিটিও এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য ডিএসইকে জানায়নি। ফলে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন সম্পর্কে বর্তমানে ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, গাজীপুরের কামরাঙ্গাচলায় অবস্থিত নিউ লাইন ক্লোথিংসের কারখানা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসের এক তারিখে কোম্পানিটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাংক ঋণ ও শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দিতে না পারায় কোম্পানিটির কারখানার উৎপাদনসহ সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। যে কারখানাটিতে প্রায় ৪ হাজার শ্রমিক কাজ করতো, সেটি এখন খা খা করছে। সেখানে বর্তমানে শুধুমাত্র একজন নিরাপত্তা প্রহরী রয়েছেন, যিনি কোনোরকমে কারখানা দেখভাল করছেন। কারখানায় কোটি কোটি টাকার মেশিনারিজগুলো অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। এভাবে পড়ে থাকলে অচিরেই মেশিনারিজগুলোর কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, কারখানাটির আনুমানিক ৩০০ জন স্টাফের এখনো এক মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে এবং আনুমানিক দেড়শো জন স্টাফের এক ঈদের বোনাস পরিশোধ করেনি কোম্পানিটি। এমনকি নিরাপত্তা প্রহরীও সাত মাসের বেতন পান কোম্পানিটি থেকে। এনিয়ে তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। নিরাপত্তা প্রহরী ছাড়া কারখানার সকল শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছাটাই করেছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। তাদের কেউ এখনো বেকার হয়ে পড়ে আছেন। আবার কেউবা অন্য কোথাও চাকরি নিয়েছেন।

কারখানার স্টোর কিপার বিজয় বলেন, আমি এক মাসের বেতন ও একটা ঈদ বোনাস পাবো। প্রায় দুই বছর ধরে বেকার হয়ে আছি। ফুটপাতে কোনো রকমে কিছু বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, চেয়ারম্যানের আত্মীয়-স্বজনরা সবার আগে বেতন-বোনাস নিয়ে নিতো। আর আমাদের বেতন বোনাস সবার পরে দিতো কোম্পানি।

কারখানার নিরাপত্তা প্রহরী মুক্তাদির রহমান বলেন, বর্তমানে আমি কোম্পানিটির কাছে সাত মাসের বেতন পাবো। বেতন ঠিকভাবে না পাওয়ায় খুব মানবেতর জীবন-যাপন করছি। কারখানা আদৌ পুনরায় চালু হবে কিনা তাও জানি না। কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। এদিকে কারখানাটি বন্ধের কিছুদিন আগে শ্রমিকরা বেতন-বোনাসের দাবিতে আন্দোলন করেছিল। পরবর্তীতে তাদের পাওনাদি পরিশাধ করে দেয় কোম্পানি কর্তৃপক্ষ, জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।

তারা বলেন, কারখানা চলাকালিন এর আশপাশে দিনে রাতে শ্রমিকদের আনাগোনা থাকলেও এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। আর এই সুযোগে কারখানার প্রধান গেইট-এর সম্মুখভাগে ফুটপাতে ভ্যানে নিত্যপণ্য বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতারা। ফলে কারখানাটির গেইটের সামনে চলাচল করতেও সমস্যা হচ্ছে।

নিউ লাইন ক্লোথিংসের কারখানার প্রধান গেইট-এর সম্মুখভাগে ফুটপাতে ভ্যানে নিত্যপণ্য বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতারা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রায় দুই বছর ধরে উৎপাদন বন্ধ থাকলেও কোম্পানিটির কারখানা পরিদর্শনে যায়নি ডিএসই। নিউ লাইনের মতো অসংখ্য কোম্পানি রয়েছে যাদের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। অথচ এব্যাপারে অবগত নয় ডিএসই। অভিযোগ রয়েছে, লোকবল সংকটের দোহাই দিয়ে কোম্পানিগুলোর কারখানা পরিদর্শন করে না সংস্থাটি। ডিএসই’র মতো বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসিও এসব ব্যাপারে তৎপরতার পরিচয় দিচ্ছে না। ফলে মাঝখান থেকে উৎপাদন বন্ধ থাকা কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।

ডিএসই’র লিস্টিং অ্যাফেয়ার্স বিভাগের ম্যানেজার রবিউল বলেন, নিউ লাইনের উৎপাদন বন্ধের বিষয়টি আমাদের জানা নেই। কোম্পানিটি এ ব্যাপারে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য (পিএসআই) ডিএসইকে জানায়নি। তবে ডিএসই কোম্পানিটির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেবে কিনা সেব্যাপারেও কিছু বলেননি তিনি।

বিএসইসির মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বিজনেস আই বাংলাদেশকে বলেন, নিউ লাইনের উৎপাদন বন্ধ, এ সংক্রান্ত কোনো রিপোর্ট আমাদের কাছে সাবমিট করেনি ডিএসই। সংস্থাটি সাবমিট করলে আমরা পরিদর্শন করানোর উদ্যোগ নিতাম। তিনি আরও বলেন, কোনো কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ, এসংক্রান্ত কোনো রিপোর্ট ডিএসই না জানালেও আমরা নিজ উদ্যোগেও অনেক সময় সেসব কোম্পানির কারখানা পরিদর্শনে সংস্থাটিকে পাঠাই। এক্ষেত্রে নিউ লাইনের কারখানা পরিদর্শনে কাউকে পাঠানো হয়নি। তবে বিষয়টি আমি কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানাবো।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, নিউ লাইন ক্লোথিংস যন্ত্রপাতি ক্রয়, কারখানা ভবন সম্প্রসারণ, মেয়াদি ঋণ পরিশোধ ও আইপিও খাতে ব্যয় মেটাতে পুঁজিবাজার থেকে ৩০ কোটি টাকা উত্তলন করে। কিন্তু ২০১৯ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে এই টাকা উত্তোলন করলেও কারখানার ভবন সম্প্রসার‌ণ করেনি কোম্পানিটি। এমনকি নতুন কোনো যন্ত্রপাতিও ক্রয় করেনি তারা। মূলত অর্থআত্মসাতের উদ্দেশ্যেই কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে, জানান বাজার বিশ্লেষকরা।

এদিকে নিউ লাইন ক্লোথিংসের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছে শেয়ারবাজারের বিতর্কিত মার্চেন্ট ব্যাংক বানকো ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।

উল্লেখ্য, গত তিন বছর ধরে নিউ লাইন ক্লোথিংস বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দেয় না। ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে লেনদেন করা কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন একশো কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ৭৮ কোটি ৫৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা। মোট শেয়ার সংখ্যা ৭ কোটি ৮৫ লাখ ৩২ হাজার ৬৫০টি; যেখানে উদ্যোক্তা পরিচালক, প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার রয়েছে যথাক্রমে ৩০ দশমিক ৬১ শতাংশ, ১৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ ও ৫১ দশমিক ০৬ শতাংশ। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোম্পানিটির সমাপনী শেয়ার দর ছিল ১০ টাকা ১০ পয়সা।

নিউজটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন