নিজস্ব প্রতিবেদক
‘জন্ম থেকেই বাংলাদেশী’ স্লোগান নিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া রানার অটোমোবাইলস পিএলসি বিনিয়োগকারীদের সাথে নয়-ছয় করছে। কোম্পানিটি আলো থেকে অন্ধকারের পথে ধাবিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত; যা তাদের আর্থিক প্রতিবেদন দেখলেই বোঝা যায়।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ব্যবসায়ীকভাবে ধুকছে কোম্পানিটি। প্রায় দুই বছর ধরে কোম্পানি লোকসানে রয়েছে। উল্লেখযোগ্য হারে উৎপাদন কমেছে কোম্পানির। ২০০০ সালে যাত্রা শুরু করা রানার অটোমোবাইলস দীর্ঘদিন সফলতার গল্প শুনিয়েছে দেশের মানুষকে। কিন্তু পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির ৫ বছর যেতে না যেতেই যেন সেসব সফলতায় ঘুণ ধরতে শুরু করেছে। অতিতের সফলতা দেখে অনেক আশা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগ করে সর্বনাশ হয়েছে লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর।
বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, রানার বিনিয়োগকারীদের সাথে শুধু প্রতারণাই করেনি, করেছে বিশ্বাস ভঙ্গও। ২০২২ সালে ২৭ কোটি টাকা প্রফিট করলেও কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড দেয়নি। ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেও ডিভিডেন্ড না দেয়া শেয়ারবাজারের জন্য মোটেও সুখকর নয়। কোম্পানির এই ধরনের ছলচাতুরি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। একই সাথে কোম্পানির এমন আচরনে বিনিয়োগকারীরা চরমভাবে হতাশ ও ক্ষুব্ধ। এদিকে সর্বশেষ অর্থবছরে রানার বিনিয়োগকারীদের জন্য ‘নো’ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে। ফলে কোম্পানির শেয়ার দামে মারাত্মক নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। এতে বিনিয়োগকারীরা বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে রীতিমতো তামাশা শুরু করেছে কোম্পানিটি; যা প্রতারণার সামিল বলেও মনে করেন তারা।
বিএসইসির কাছে কোম্পানির এই স্বেচ্চাচারিতার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করবেন বলেও কেউ কেউ জানিয়েছেন। সর্বশেষ অর্থবছরে রানার আসলেই লোকসানে রয়েছে কিনা, তা কঠোরভাবে খতিয়ে দেখা উচিত। আর ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেও ডিভিডেন্ড না দেয়ায় বিএসইসি যদি ব্যবস্থা না নেয়, তবে বাজারের সামগ্রিক সুশানের ঘাটতির চিত্র ফুটে উঠবে। এ ধরনের প্রতারণা বন্ধ না করতে পারলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের রক্ষা করা যাবে না বলে মনে করেন মনোয়ার নামে একজন বিনিয়োগকারী। তার মতে, রানার বিএসইসির নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রাথমিক গণ প্রস্তাবে (আইপিও) আসার আগে রানারের ব্যবসায়িক সফলতা ছিলো উল্লেখ করার মতো। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, ততই প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারে হতাশ হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। ২০১৯ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া রানার অটোমোবাইলসের সেসময় শেয়ার প্রতি আয় ছিলো ৫ টাকা ০৭ পয়সা। সর্বশেষ হিসাব বছরে (২০২৩) কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি মুনাফাতো ধরে রাখতে পারেইনি; উপরন্তু লোকসান গুণতে হয়েছে। ২০২৩ সালে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে ৭ টাকা ৭৫ পয়সা। আর চলতি হিসাব বছরে (২০২৪) গত তিন প্রান্তিক (জুলাই, ২০২৩- মার্চ, ২০২৪) মিলে মোট লোকসান হয়েছে ৩ টাকা ৫৭ পয়সা। ২০২২ সালে কোম্পানিটি ১০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেও তা বিনেয়োগকারীদের মাঝে বিতরণ করেনি। আর সর্বশেষ হিসাব বছরেতো রানার ‘নো’ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির আগে রানার অটোমোবাইলসের কাট-অফ প্রাইস নির্ধারণ হয়েছিল ৭৫ টাকা। আর শেয়ারটির ইস্যু মূল্য ছিলো ৬৮ টাকা। বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ার দর এসে দাঁড়িয়েছে ২০ টাকা ৮০ পয়সা। এক্ষেত্রে শেয়ার দর কমেছে ৬৯ শতাংশ। ২০২৩ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত বছরের তথ্য অনুসারে, প্রতিষ্ঠানটির ৭০৩ কোটি টাকা স্বল্প মেয়াদি ঋণ, আর ৫৯১ কোটি ৬২ লাখ টাকা দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ রয়েছে। ২০১৯ সালে রানারের মুনাফা ছিলো ৫০ কোটি টাকা। আর ২০২৩ সালে লোকসান হয়েছে ৮৮ কোটি টাকা। ব্যবসা সম্প্রসারণ ও মুনাফা বৃদ্ধির জন্য পুঁজিবাজার থেকে আইপিও-এর মাধ্যমে ১০০ কোটি টাকা উত্তোলন করে রানার। এই টাকার বড় একটি অংশ দিয়ে থ্রি-হুইলার প্ল্যান্ট স্থাপন করে।
গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি রানারের থ্রি-হুইলার অটোরিকশা বাজারে আসে। কোনো কোম্পানির ব্যবসায় নতুন কোনো পণ্য যুক্ত হলে সাধারণত আয় বৃদ্ধি পায়। কিন্তু রানার অটোমোবাইলসের ক্ষেত্রে হয়েছে উল্টোটি। থ্রি-হুইলার অটোরিকশা বাজারে সরবরাহ করেও আয় বৃদ্ধি করতে পারেনি, বরং চরম লোকসানে পড়েছে।
জানা গেছে, যেকোনো কোম্পানিতে সাধারণত সবচেয়ে বেশি জেনে-বুঝে বিনিয়োগ করে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। সেই প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাই রানার অটোমোবাইলস থেকে বিনিয়োগ উঠিয়ে নিচ্ছে। তারা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে শেয়ার ধরিয়ে দিচ্ছে। ২০২৩ সালের ৩০ জুন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ছিলো ৩৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। আর সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বিনিয়োগ এসে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমেছে ২৫ শতাংশ। ইতিমধ্যে কোম্পানিটি শেয়ারবাজারের সবচেয়ে নিম্ন ক্যাটাগরি ‘জেড’- এ অবস্থান করছে।
ডিভিডেন্ড বিতরণ না করায় মূলত বিএসইসি কোম্পানিটিকে ‘জেড গ্রুপে পাঠায়। বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, নিয়ম হচ্ছে যেকোনো কোম্পানি সক্ষমতা অনুযায়ী যখন ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে, তার ১০ দিনের মধ্যে কোম্পানির আলাদা একটি হিসাবে এই ডিভিডেন্ডের টাকা রেখে দেবে। তাই পরে লোকসান হলেও সেই ডিভিডেন্ড দিতে সমস্যা হওয়ার কথা নয় কোম্পানির। এক্ষেত্রে ডিভিডেন্ড দিতে সক্ষমতা থাকা স্বত্তেও বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রতারণা করেছে রানার অটোমোবাইলস। রানার-‘জন্ম থেকেই বাংলাদেশী’ এই স্লোগান দিয়ে বিনিয়োগকারীদের ঠকিয়েছে। আর বিনিয়োগকারীদের ঠকানো মানে বাংলাদেশকে ঠকানো। তাই তাদের মুখের স্লোগানের সঙ্গে অন্তরের স্লোগানের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।
রানার অটোমোবাইলসে প্রধান অর্থ কর্মকর্তা সানাত দত্ত বিজনেস আই বাংলাদেশকে বলেন, পণ্য বিক্রির পরিমাণ চরমভাবে কমে যাওয়ায় লোকসানে রয়েছে কোম্পানি। উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় কাঁচামালসহ আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র আমদানি করতে পারছি না। ফলে বাজারে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
চলবে……