ডেঙ্গুতে কুমিল্লার অভিজ্ঞ গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. ফাহমিদা আজিম কাকলির মৃত্যু আমাদের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার গভীর অসামর্থ্যকে আবারও সামনে এনেছে। কুমিল্লার একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক নিজ শহরে প্রয়োজনীয় আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা না পাওয়ার আশঙ্কায় ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান, কিন্তু ততক্ষণে মূল্যবান সময় পেরিয়ে যায়। এটি শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, বরং ডেঙ্গুর মতো দ্রুত জটিল হয়ে ওঠা রোগ মোকাবিলায় স্থানীয় পর্যায়ে আমাদের প্রস্তুতির কত ঘাটতি রয়েছে, তা নির্মমভাবে তুলে ধরে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রথম এবং সবচেয়ে বড় দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। তাদের কাজ হলো মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করা, লার্ভা নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত অভিযান চালানো, নালা-নর্দমা পরিষ্কার রাখা, কার্যকর ওষুধ ছিটানো এবং এসব কার্যক্রমের ধারাবাহিক তদারকি করা। কিন্তু বাস্তবে এসব কাজ কতটা হয়, তার কোনো স্বচ্ছ ব্যাখ্যা নেই। বরং প্রতি বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়, আর কোটি কোটি টাকার ওষুধ কেনা, সেই ওষুধের মান, মাঠপর্যায়ে প্রয়োগ, সবকিছু নিয়েই প্রশ্ন থাকে। করদাতাদের অর্থে পরিচালিত এসব উদ্যোগ সম্পর্কে করদাতাদের কাছেই বাস্তব কোনো জবাবদিহি নেই। এটাই সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।
স্বাস্থ্য বিভাগও এই সংকটে পিছিয়ে নেই। ডেঙ্গুর গুরুতর জটিলতা যেমন লিভার বা কিডনি বিকল হওয়া খুব দ্রুত ঘটে, তাই জেলা পর্যায়েই উন্নত ও জরুরি চিকিৎসা সুবিধা থাকা অপরিহার্য। কিন্তু বাস্তব চিত্র হলো, পর্যাপ্ত আইসিইউ নেই, প্রয়োজনীয় ল্যাব সুবিধা সীমিত, চিকিৎসক সংকট রয়েছে এবং জটিল রোগী সামলানোর সক্ষমতাও যথেষ্ট নয়। ফলে রোগীরা ঢাকার দিকে ছুটে আসতে বাধ্য হন, যা অনেক সময় চিকিৎসার স্বর্ণসময় নষ্ট করে দেয়। ডা. কাকলির মতো অভিজ্ঞ চিকিৎসকও যখন ঢাকায় ছুটে আসার প্রয়োজন অনুভব করেন, তখন এ সীমাবদ্ধতা আর আড়াল থাকে না।
প্রতিবছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে, কিন্তু ব্যর্থতার তদন্ত হয় না। কোন সংস্থা কোথায় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলো, তার মূল্যায়ন হয় না। একই ভুল বারবার ঘটতে থাকে, আর আমরা শোক বার্তায় বছর পার করি। অথচ ডেঙ্গু প্রতিরোধযোগ্য রোগ। তবুও আমরা এটিকে এক ধরনের বার্ষিক বিপর্যয় হিসেবে মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি, কারণ আমাদের প্রতিরোধ কৌশলের মূল জায়গাটিতে জবাবদিহির অভাব রয়ে গেছে।
এই পরিস্থিতি বদলাতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন জনগণের জানার অধিকার নিশ্চিত করা। সিটি কর্পোরেশনের বাজেট, ওষুধ কেনাকাটা, কাজের অগ্রগতি ও কার্যকারিতা, সব তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করা জরুরি। স্বাস্থ্য বিভাগকে জেলা পর্যায়ে জরুরি চিকিৎসা সক্ষমতা বাড়াতে দ্রুত ও দৃঢ় উদ্যোগ নিতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কোনো ব্যর্থতার দায় কেউ না নিলে ব্যর্থতা স্থায়ী হয়ে যায়। ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে কার্যকর লড়াই শুরু হবে সেদিন, যেদিন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সত্যিকার অর্থে জনগণের কাছে জবাবদিহি হতে বাধ্য হবে।
ডা. সাগর খান
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
[email protected]