ঢাকা, শনিবার, ২ অগাস্ট ২০২৫, ৭:২৯ অপরাহ্ন

সাড়ে ১২ লাখ জীবনবীমা পলিসি বাতিল

২০২৪ সালের শেষ নাগাদ দেশের ৩৫টি জীবনবিমা কোম্পানির মোট ৭০ লাখ ৮৬ হাজার পলিসির মধ্যে অন্তত ১২ লাখ ৫০ হাজার পলিসিই এখন কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে, যার হার মোট পলিসির ১৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

তালিকার শীর্ষে রয়েছে নতুন প্রজন্মের কোম্পানি সোনালী লাইফ ইনস্যুরেন্স, প্রতিষ্ঠানটির মোট ২ লাখ ৮৫ হাজার ৩১১টি পলিসির মধ্যে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৬৬৮টিই তামাদি, যার হার প্রায় ৮৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ডেল্টা লাইফ, যেখানে ১০ লাখ ৯৩ হাজার ৭৯৭টি পলিসির মধ্যে ১ লাখ ৯৩ হাজার ৭৬৮টি তামাদি। তৃতীয় স্থানে থাকা পপুলার লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির ৭ লাখ ২৫ হাজার ৭৬৬টি পলিসির মধ্যে তামাদি হয়েছে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৯টি। ন্যাশনাল লাইফ ইনস্যুরেন্সের মোট ১৯ লাখ ৪৯ হাজার ৭৯৫টি পলিসির মধ্যে ১ লাখ ৫০ হাজার ৮৪৫টি পলিসি তামাদি হয়েছে। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে এই হারও উদ্বেগজনক, যা বিমা খাতে আস্থার সংকট এবং কাঠামোগত দুর্বলতার গভীরতা স্পষ্ট করে তোলে।

অন্যদিকে এই তামাদি পলিসির বিপরীতে গ্রাহকদের দাবি ছিল ১২ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা, কিন্তু পরিশোধ হয়েছে মাত্র ৮ হাজার ৫৯০ কোটি। অর্থাৎ ৪ হাজার ৩৫ কোটি টাকা আটকে আছে বিমা কোম্পানির কাছে। এই অর্থ পেতে বছরের পর বছর ধরে কোম্পানির অফিস, আইডিআরএ ও সরকারের দপ্তরগুলোতে ঘুরছেন ভুক্তভোগীরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা শুধুই প্রশাসনিক শৈথিল্য নয়, বিমা খাতের ভিতেই জমে থাকা গভীর আস্থার সংকটের প্রতিফলন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক মো. মাইন উদ্দিন সরাসরি দায় দিলেন কমিশনভিত্তিক বিক্রয় ব্যবস্থাকে। তাঁর ভাষায়, ‘এজেন্টদের দু-তিন বছরের জন্য অতিরিক্ত কমিশন দেওয়া হয়, ফলে তাঁরা আত্মীয়-পরিজনদের জোর করে বিমায় যুক্ত করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে খোঁজ না রাখায় গ্রাহকেরাও বিমা চালু রাখেন না।’

এজেন্টের হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া, পলিসির শর্তাবলি সঠিকভাবে না বোঝানো, অনলাইন প্রিমিয়াম পেমেন্টের জটিলতা—এসবই ধীরে ধীরে গ্রাহকদের বিমুখ করে দিচ্ছে। অনেকেই বলেন, ‘যা দিয়েছি তা গেল, আর দেব না।’

আইডিআরএর চেয়ারম্যান ড. এম আসলাম আলম স্বীকার করেছেন, তামাদি বিমা নিয়েই এখন তাঁরা সবচেয়ে বেশি চিন্তিত। তাঁর ভাষায়, শুধু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং লাইসেন্সধারী এজেন্ট দিয়েই বিমা করাতে হবে। না হলে কোম্পানির লাইসেন্স বাতিলের মতো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স ফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এস এম নুরুজ্জামান বলেন, তামাদি পলিসি বিমা খাতের ক্যানসার, যা না কাটা গেলে পুরো সিস্টেম ধ্বংস হয়ে যাবে।

বিশ্লেষকদের মতে, পলিসি যতই হোক, যদি তারা কার্যকর না থাকে, তবে সেটা শুধুই সংখ্যা। আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য এখনই দরকার কঠোর নিয়ন্ত্রক ভূমিকা, কমিশন-কাঠামোতে সংস্কার, সহজ ও স্বচ্ছ প্রিমিয়াম পেমেন্ট ব্যবস্থা এবং এজেন্টদের ওপর জবাবদিহিমূলক নজরদারি। না হলে দেশের লাখো মানুষ যেমন বঞ্চিত হবে ভবিষ্যৎ সুরক্ষার অধিকার থেকে, তেমনি দেশের বিমা খাত আর কখনো দাঁড়াতে পারবে না বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর।

 

নিউজটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

ট্যাগঃ