চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে ৩৯ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা, যা তিন মাস আগের তুলনায় প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ১১ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

২০২৫ সালের মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ২৩ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। এক বছর আগে ২০২৪ সালের মার্চ শেষে এই পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ৬২ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে গত এক বছরে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ২০২ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার পরিবর্তন, প্রবাসী আয়ের ধারাবাহিক প্রবাহ এবং কিছু ব্যাংকের উদ্যোগী ভূমিকার ফলে খাতটিতে ধীরে ধীরে আস্থা ফিরতে শুরু করেছে।
আস্থা ফিরছে, ভূমিকা রাখছে রেমিট্যান্স

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, আমানত বাড়ার পেছনে মূলত দুটি কারণ কাজ করেছে—প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং খাত নিয়ে মানুষের আস্থা কিছুটা ফিরে আসা।
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মারুফ বলেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, সম্প্রতি আমানতের প্রবৃদ্ধির পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেমিট্যান্সের। গত ছয় মাসে প্রবাসী আয় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এর একটি বড় অংশ আবার ব্যাংকিং চ্যানেলে জমা হচ্ছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসায় ব্যাংকিং খাতের প্রতি মানুষের আস্থা কিছুটা বেড়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংক খাত সংস্কারে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দুর্বল ও অনিয়মগ্রস্ত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন এবং নতুন নেতৃত্ব এসেছে। এসব উদ্যোগ আমানতের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
শীর্ষে যেসব ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্র্যাক ব্যাংক আমানত প্রবৃদ্ধির তালিকায় শীর্ষে। ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে ৩৮ দশমিক ৫১ শতাংশ, যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৭৬ হাজার ৫৪ কোটি টাকা। সিটি ব্যাংকের প্রচলিত ব্যাংকিং বিভাগে ২৫ দশমিক ২২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়ে আমানত দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার ৯১৩ কোটি টাকায়। ব্যাংকটির ইসলামি ব্যাংকিং বিভাগেও প্রায় ৪১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যেখানে আমানত ৬ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা। ইস্টার্ন ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৫ দশমিক ১২ শতাংশ, যা দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার ৯০২ কোটি টাকায়। ব্যাংকটির ইসলামি ব্যাংকিংয়ে রয়েছে আরও ৯৪৬ কোটি টাকা।
শীর্ষ ১০ আমানত প্রবৃদ্ধির ব্যাংকের তালিকায় আরও রয়েছে—যমুনা ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, এমটিবি (মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক) ও ব্যাংক এশিয়া।
প্রবৃদ্ধির বাইরে কিছু ব্যাংক
যদিও সামগ্রিক খাতে আমানত বাড়ছে, তবে সব ব্যাংকের পরিস্থিতি এক রকম নয়। কিছু বেসরকারি ব্যাংকে আমানত হ্রাসের ধারা অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ন্যাশনাল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী, এবি ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ও মধুমতি—এই ৯ ব্যাংকে আমানত কমছে।
ঋণের প্রবৃদ্ধি কম, শহরমুখী বিতরণ
তিন মাসে আমানতের প্রবৃদ্ধি বেশি হলেও ঋণে কিছুটা প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে ঋণ বেড়েছে ২৯ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা, যা ১ দশমিক ৭৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ১২ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। গত অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে যার পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। তবে ঋণ বিতরণে বৈষম্য রয়েছে। শহরাঞ্চলে দেওয়া হয়েছে মোট ঋণের ৯২ শতাংশ বা ১৫ লাখ ৭৫ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা। অপর দিকে গ্রামীণ অর্থনীতিতে গেছে মাত্র ৮ শতাংশ বা ১ লাখ ৩৬ হাজার ৭২১ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক খাতে প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে হলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও অনিয়ম পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধি এবং নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে সাময়িক আস্থার এই ঊর্ধ্বগতি দীর্ঘস্থায়ী হবে না।