ঢাকা, বুধবার, ৬ অগাস্ট ২০২৫, ৪:২১ অপরাহ্ন

ড. ইফফাত জাহানের ‘পেটে’ প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিজেকে পরিচয় দিতেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহেনার বান্ধবী হিসেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ট্রেজারার হওয়ার পরও অধিকাংশ সময় ব্যয় করতেন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কার্যক্রমে। করতেন না ঠিকমতো অফিস। তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কাজে নিজের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে কামাতেন মোটা অংকের টাকা। বলছিলাম ড. ইফফাত জাহানের কথা। বর্তমানে তিনি প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার হিসেবে কর্মরত আছেন।

বিজনেস আই বাংলাদেশের হাতে আসা তথ্য বলছে, স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণে দুর্নীতি, শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রমে দুর্নীতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্য কিনতে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে। যা নিয়ে একটি অভ্যন্তরিণ অডিট করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেখানে এসব তথ্যের প্রমাণ মিলেছে। যার কাগজ সংরক্ষণ রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ ছাড়াও বিভিন্ন খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ (বিওটি) তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হলে পিঠ বাঁচাতে ইফফাত ও টিটু সম্প্রতি নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতৃত্বে পরিকল্পিতভাবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক আন্দোলনে ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততার কথা জানাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রও।

সাম্প্রতিক এ আন্দোলনে যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপসারিত হওয়া শিক্ষক সাইয়েদ সরোয়ার মুগ্ধ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ ডিরেক্টর নজরুল ইসলামের সম্পৃক্ততার অভিযোগও উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনিয়মের কারণে অপসারিত হওয়ায় মুগ্ধ বোর্ড অব ট্রাস্টিজ অপসারণে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর মোহাম্মাদ বিল্লাল হোসেন, মশিউর রহমান, মোহাম্মাদ এমদাদুল হক, আনোয়ার হোসেইন এবং শাহরিয়ার কবির অপরাধীদের সাথে সরাসরি জড়িয়ে ছাত্র আন্দোলন উস্কে দিয়ে দুর্নীতিবাজদের রক্ষার চেষ্টা করেছেন। এই পাঁচজন প্রক্টরকে   নিয়ম বহির্ভূতভাবে ভাবে ৬,৯৫,২৪৭ টাকা করোনোকালীন কর্তিত বেতন হিসাবে দিয়েছেন ইফ্ফাত জাহান। এছাড়া ইফ্ফাত জাহান নানাসময়ে আর্থিক সুবিধা দিয়ে নিজের দলে ভিড়ান এবং ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করেন। আর এতে প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটি শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সাদমান সারোয়ার, সাংগঠনিক সম্পাদক হাসিবুল হোসেন রেমন ওরফে রেমন খান এবং কর্মী মো. মুহতাসিম ফুয়াদ, এ আর মাহবুব চৌধুরী আবির, আরিয়ান চৌধুরী আরিফ, ইশতিয়াক আহমেদ, ফাহিম ভূঁইয়া প্রমুখ সরাসরি যুক্ত ছিলেন।

নিয়ম ভেঙে স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণে চুক্তি: নিয়ম অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়নকাজে খরচের পরিমাণ ৫ লাখ টাকার বেশি হলে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করতে হয়। সেক্ষেত্রে অর্থ কমিটি, ক্রয় কমিটি ও ট্রাস্টি বোর্ডের অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু ২০২৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণে ৮ কোটি ৭২ লাখ টাকার কাজে দরপত্র আহ্বান না করেই চুক্তি করা হয়। ইফফাত জাহান ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্বে থাকাকালীন টিটুর সঙ্গে মিলে অর্থ কমিটি, ক্রয় কমিটি কিংবা বিওটির অনুমোদন ছাড়াই এই চুক্তি করেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইনফিকম এস এ কন্সট্রাকশন বিডির পরিচালক বর্তমান রাষ্ট্রপতির ছেলে আরশাদ আদনান। চুক্তির পর পরই প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ১৫ মার্চের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়কে কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের। সময়মতো ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজ বুঝিয়ে না দিলে কর্তৃপক্ষ কার্যাদেশ বাতিল করতে পারবে বলেও উল্লেখ ছিল চুক্তিতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই চুক্তিতে অস্বাভাবিক খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী আমানত বা ফিক্সড ডিপোজিট (এফডিআর) ভেঙে প্রায় ৪ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। আবার ক্যাম্পাস নির্মাণের অল্প কিছু কাজ করেই ঠিকাদার পালিয়ে গেছেন। তখন ইফফাত ও টিটু কাজ শুরুর কথা বলে বিওটির মাধ্যমে আরও ৫০ লাখ টাকা আনেন। তার পরও কাজ শুরু হয়নি, চুক্তিও বাতিল হয়নি। নতুন করে নির্মাণকাজ শুরুর কথা জানতে পেরে অভিযুক্তদের নির্দেশে আগের চুক্তি বহালে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে।

আরও যত অনিয়ম: গত সাড়ে চার বছরে এফডিআর ভেঙে ও আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টির অন্তত ২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভিন্ন অফিসের সাজসজ্জা, পরামর্শক নিয়োগ, ডিজিটাল মার্কেটিং, কনসালটেন্সি ফি, অফিস ডেকোরেশন, আসবাবপত্র ক্রয়, বিজ্ঞাপন ব্যয়, ডিজিটাল মার্কেটিং, প্রচার, গাড়ি ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি ক্রয়, গবেষণাগারের সামগ্রী ক্রয়, ক্লিনিং ও সিকিউরিটি বিল, ক্যাম্পাস উদ্বোধন অনুষ্ঠান, স্পোর্টস ক্লাবের সদস্যপদ বিক্রি, শিক্ষার্থী ভর্তি ফিসহ নানা খাতে এসব আর্থিক অনিয়ম করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক বিবরণী, অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদন ও সংশ্লিষ্ট হিসাবাদি বিশ্লেষণে এসব অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব অনিয়মের প্রায় সব কটিতেই জড়িত ছিলেন রায়হান আজাদ টিটু। এর আগে নানা অনিয়মের অভিযোগে তাকে সেখান থেকে অপসারণও করা হয়েছিল। জড়িতদের মধ্যে আরও ছিলেন সাবেক ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ড. শুভময় দত্ত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব শাখার পরিচালক (সাময়িক বরখাস্তকৃত) শিপার আহমেদ। শিপার আহমেদের বিরুদ্ধে ভর্তি অফিস থেকে প্রায় ৮০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এসব অনিয়মে তাদের সহায়তা করেছেন ভর্তি ও বিপণন শাখার সাময়িক বরখাস্তকৃত সহকারী পরিচালক তানভীর আহমেদ, ক্রয় বিভাগ থেকে পদত্যাগ করা সহকারী পরিচালক নাহিদ হাসান ও সহকারী পরিচালক জুবায়ের সিদ্দিক তানিন। এ ছাড়াও সহায়তাকারী ছিলেন এমবিএ প্রোগ্রামের অপসারিত শিক্ষক সাইয়েদ ফেরদৌস মুগ্ধ। আর কোষাধ্যক্ষ হিসেবে আর্থিক অনিয়ম সংগঠিত হওয়ার পেছনে ইফফাত জাহানের হাত রয়েছে।

জানা গেছে, বনানীতে বিশ্ববিদ্যালয় ভবনে টিটু ও তার পরিবারের চারটি রেস্টুরেন্ট ও ক্যান্টিন রয়েছে। এর মধ্যে একটি তারা ভাড়া দিয়ে টাকা নিচ্ছেন। বাকিগুলোর ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিল প্রতিষ্ঠান থেকে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই খাতে তাদের কাছে পাওনা রয়েছে ৫ কোটি টাকার ওপরে। এমন নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বর্তমানে বকেয়া রয়েছে সেখানকার শিক্ষকদের বেতন-ভাতাও। এক বছরের ভাড়া বকেয়া রয়েছে এইচবিআর টাওয়ারের। বকেয়া ভাড়ার কারণে ক্যাম্পাস ছেড়ে দেওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০২০ সাল থেকে প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটিতে কোনো ধরনের অডিট না হওয়া, আর্থিক বাজেট না করা, ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল না করার ফলে এসব অনিয়ম করার সুযোগ পেয়েছেন অভিযুক্তরা। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) কোনো প্রতিবেদনও জমা দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয়টি। বাজেটসহ আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত করার দায়িত্ব কোষাধ্যক্ষের হলেও তিনি সেটি করছেন না। যে কারণে তাকে শোকজও করা হয়েছিল। কিন্তু কাজ হয়নি। উল্টো ইফফাত জাহান ও টিটুসহ অন্যদের বিভিন্ন অনিয়ম সামনে আনায় শিক্ষার্থীদের দিয়ে আন্দোলন করিয়ে উপাচার্য ড. শুভময় দত্তকে পদত্যাগ করানো হয়েছে।

নিউজটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

ট্যাগঃ