ঢাকা, বুধবার, ৬ অগাস্ট ২০২৫, ৬:৩৩ অপরাহ্ন

ঝুঁকিপূর্ণ কোম্পানি ‘দুয়ার’ থেকে রক্ষা পেল বিনিয়োগকারীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

পুঁজিবাজারে আরও একটি দুর্বল ঝুঁকিপূর্ণ কোম্পানির শেয়ারের ফাঁদে পড়তে যাচ্ছিল বিনিয়োগকারীরা। তবে শেষ মুহূর্তে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) হস্তক্ষেপে ও গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর ‘দুয়ার সার্ভিসেস’ নামে এসএমই খাতের কোম্পানিটির কিউআই আবেদন স্থগিত করা হয়েছে।

গত মঙ্গলবার (১৩ জানুয়ারি) বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কোম্পানিটির কোয়ালিফাইড ইনভেস্টর অফার (কিউআই) আবেদন স্থগিত করেছে। একইসঙ্গে কোম্পানিটি নিয়ে বিএসইসি ও ডিএসই কর্মকর্তারা যৌথভাবে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এর আগে কোম্পানিটির কিউআই আবেদনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল ৯ থেকে ২৩ জানুয়ারি পরযন্ত।

প্রসপেক্টাসের তথ্য অনুসারে , দুয়ার সার্ভিসেস এর মূল পণ্য ডিজিটাল সেবা। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রতিবেদন, গ্রাহক, মালিকানা এবং ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি সবকিছুই রহস্যাবৃত। মূলত এই কোম্পানির গ্রাহক সংখ্যা ২। এর মধ্যে রয়েছে- অগ্রণী ব্যাংক এবং বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। মোট আয়ের ৯৯ শতাংশ দেখানো হয়েছে ‘দুই’ গ্রাহকের কাছ থেকে। অন্যদিকে ‘দুয়ার সার্ভিসের’ কাছ থেকে অগ্রণী ব্যাংকের এই সেবাগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আইডিআরএ’র সেবাগ্রহণ নিয়েও বিমা কোম্পানিগুলো ব্যাপক আপত্তি তুলেছে। এরপরও এই কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দিয়েছে বিএসইসি। এ ব্যাপারে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) আপত্তিকে আমলে নেয়নি কমিশন।

দুয়ার সার্ভিসেস এর সেবা

জানা গেছে, ‘দুয়ার সার্ভিস’ মূলত এজেন্ট ব্যাংকিং, সফটওয়্যার সেবা এবং ডিজিটাল সার্ভিসের কাজ করে। কোম্পানি আগে গঠন হলেও ২০১৯ সাল থেকে মূল কাজ শুরু হয়। শুরুতে এর মূলধন ছিল মাত্র ১০ লাখ টাকা। এরপর পরিশোধিত মূলধন ৪৪৫ গুণ বাড়িয়ে ৪৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা করা হয়েছে। শেয়ারবাজার থেকে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের ৫০ লাখ শেয়ার ছেড়ে ৫ কোটি টাকা সংগ্রহের অনুমতি দিয়েছে বিএসইসি।

মূলত অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতের কমিশন এই অনুমোদন দেয়। কোম্পানির ইস্যু ম্যানেজার হিসাবে রয়েছে আলফা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট। নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান জি. কিবরিয়া অ্যান্ড কোং।

আয় ও মুনাফায় যত গরমিল

এদিকে এ কোম্পানির আয় এবং মুনাফাও রহস্যাবৃত। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কোম্পানির মোট আয় ৭৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে মুনাফা ২১ কোটি ১০ লাখ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আয় ৭১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। বিপরীতে মুনাফা ২১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। আবার ২০২১ সালে আয় ৪২ কোটি ৭৪ লাখ। এর বিপরীতেও মুনাফা ২১ কোটি টাকা। অর্থাৎ আয় যতই বাড়ুক, মুনাফা কাছাকাছি রয়েছে। কোম্পানির প্রতি শেয়ারের বিপরীতে আয় (ইপিএস) দেখানো হয়েছে ৪ দশমিক ৭৪ টাকা। সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে গ্রাহক সংখ্যা মাত্র তিন। তবে মূল গ্রাহক সংখ্যা ২। এর মধ্যে রয়েছে-অগ্রণী ব্যাংক এবং আইডিআরএ। মোট আয়ের ৯৯ শতাংশই এই দুই প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে। বাকি ১ শতাংশেরও কম আয় এসেছে, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথোরিটি (এমআরএ) থেকে।

সর্বশেষ বছরে অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ৭৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা আয়ের মধ্যে শুধু অগ্রণী ব্যাংকের কাছ থেকে এসেছে ৬৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা, যা কোম্পানির মোট আয়ের ৮২ শতাংশ শতাংশ। এছাড়া আইডিআরএ থেকে এসেছে ১২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বা ১৭ দশমিক ১০ শতাংশ এবং এমআরএ ১১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা বা দশমিক ৯০ শতাংশ। যেহেতু কোম্পানিটি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই সেবা নিতে বাধ্য করেছে, তাই প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন করে এই সেবা না নিতে চাইলে কোম্পানিটি অস্তিস্ব সংকটে পড়বে।

দুয়ার সার্ভিসের সেবা নিয়ে অনিয়ম

এদিকে দুয়ারের সেবাগ্রহণ ইস্যুতে অগ্রণী ব্যাংকের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারি এই ব্যাংকটি এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এমন অভিযোগ তুলে বলেছে, ব্যাংকটি নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন সফটওয়্যার ব্যবহারের পরিবর্তে তৃতীয় পক্ষের সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আরও বলেছে, ২০২৩ সালে প্রতি মাসে দুয়ার সার্ভিসেসকে শুধু একটি সেবার বিপরীতেই ১ কোটি ১ লাখ টাকা করে দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক, যা অর্থের অপচয়। এরপর কয়েক মাস পাওনা পরিশোধ বন্ধ করে দেয় অগ্রণী ব্যাংক।

এদিকে দুয়ারের সার্ভিসের কার্যক্রম আইডিআরএ এবং বিমা খাতেও প্রশ্নবিদ্ধ। বিমা খাতের অংশীজনদের ব্যাপক বিরোধিতা সত্ত্বেও ২০২০ সালে পতিত সরকারের প্রভাব খাটিয়ে আইডিআরএ’কে এই সেবা নিতে বাধ্য করা হয়। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন চেয়ারম্যান পতিত সরকারের সাবেক সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারীর ব্যাপক আগ্রহ ছিল। দুয়ারের মাধ্যমে চালু করা হয় ইউনিফাইড মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম (ইউএমপি)। কোনো প্রকার দরপত্র আহ্বান ছাড়াই অস্বাভাবিক মূল্য নির্ধারণ করে প্রতিষ্ঠানটিকে এ কাজ দেওয়া হয়। বর্তমানে পুরো বিমা খাত সেবাটি বন্ধ করতে চাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিমা কোম্পানিগুলো ইউএমপি সেবার বিপরীতে অর্থ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে দুয়ারের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে।

দুয়ারের আইপিও নিয়ে ডিএসইর আপত্তি

অন্যদিকে আইপিও অনুমোদনের আগে ২০২৩ সালের ৭ আগস্ট ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের ১০৫৮তম সভায় কোম্পানির খসড়া প্রসপেক্টাস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে দুয়ার সার্ভিসের আবেদন কোনোভাবেই সুপারিশযোগ্য নয়। কারণ ২০১৯ সালে কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০২২ সাল পর্যন্ত কোম্পানির আয় বেড়েছে ৫৬ শতাংশ। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আয় করেছে ১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ২০২০ সালে ২০ কোটি ৬০ লাখ, ২০২১ সালে ৪২ কোটি ৭৪ লাখ, ২০২২ সালের ৩০ জুন ৬১ কোটি ৬৩ লাখ এবং পরবর্তী ৬ মাস অর্থাৎ একই বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আয় করেছে ২৮ কোটি ০১ লাখ।

আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটি ৪৪৫ গুণ বোনাস লভ্যাংশ শেয়ার ঘোষণা করে পরিশোধিত মূলধন ৪৪ কোটি ৫০ লাখ টাকায় উন্নীত করেছে। কোম্পানিটি কেবল আইপিওতে আসার জন্যই এই মূলধন বাড়িয়েছে। এছাড়াও কোম্পানিটি তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সেলোস্কোপ লিমিটেডকে ১০ কোটি টাকা সুদবিহীন ঋণ দিয়েছে। এ ধরনের কাজ বিএসইসির নির্দেশনা লঙ্ঘন।

এ ছাড়াও সেলোস্কোপ লিমিটেড ২০১৯ সালের পর কোনো নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। সহযোগী প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবরণের অভাবে লেনদেনের আর্থিক সুবিধা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। ফলে এই ধরনের আইপিও অনুমোদন যোগ্য নয়। তবে পরবর্তীতে কোম্পানিটি সফটওয়্যার ক্রয় দেখিয়ে সহযোগী কোম্পানির সঙ্গে ৬ কোটি টাকা সমন্বয়ের কথা বলেছে। এদিকে এজেন্ট ব্যাংকিং, ইউএমপির বাইরে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের কথা জানিয়েছে কোম্পানিটি। এক্ষেত্রে ৫টি বিও অ্যাকাউন্টের কথা কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অ্যাপেক্স ইনভেস্টমেন্ট, আলফা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট, ইউনাইটেড ফাইন্যান্সিয়াল ট্রেডিং, এসআইবিএল সিকিউরিটিজ এবং শান্তা সিকিউরিটিজ।

সবকিছু মিলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের কোম্পানি শুধু মূলধন সংগ্রহ নয়, এটি তালিকাভুক্তির অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করবে। তবে শেষ মুহূর্তে এসে যখন দুয়ার সার্ভিসেসের কিউআই আবেদন স্থগিত করা হয়, তখন বাজার সংশ্লিস্টরা বিএসইসির এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছে।

 

নিউজটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন