নিজস্ব প্রতিবেদক
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রকৌশল খাতের কোম্পানি আজিজ পাইপস লিমিটেড। ঋণে জর্জড়িত কোম্পানিটির উৎপাদন প্রায় ৯ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। ব্যবসা পরিচালনার জন্য মূলধন ও কাঁচামালের অভাবে কোম্পানিটির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। কবে নাগাদ উৎপাদনে ফিরবে সে ব্যাপারে কোম্পানির নেই কোনো সুনির্দিষ্ট দিকে নির্দেশনা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-ডিএসইকে না জানিয়ে কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালকদের একাংশ গোপনে মাত্রাতিরিক্ত শেয়ার বিক্রি করেছেন। বর্তমানে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে শেয়ার ধারণ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণে কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স রুলস ভঙ্গ করেছে।
এদিকে এমন অনিয়ম করলেও কোম্পানিটির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৩০ জুন ২০২৪ হিসাব বছর অনুযায়ী আজিজ পাইপসের মোট সম্পদ রয়েছে ৩৩ কোটি ৫৩ লাখ ৬ হাজার ২৭৬ টাকা। আর কোম্পানিটির কাছে উত্তরা ব্যাংক ও ডাচ বাংলা ব্যাংকের সুদে-আসলে মোট পাওনা রয়েছে ১০৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা, যার মধ্যে উত্তরা ব্যাংক পাবে ৭২ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং বাকি ৩৪ কোটি ২ লাখ টাকা পাবে ডাচ-বাংলা ব্যাংক। এই ১০৬ কোটি ৫২ লাখ টাকার মধ্যে ব্যাংক দুটির কাছে কোম্পানিটির দীর্ঘ মেয়াদি লোন রয়েছে ৯ কোটি ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এদিকে মোট সম্পদের তুলনায় ঋণের পরিমাণ বেশি হওয়ায় কোম্পানিটির ঋণ পরিশোধে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে পাওনা টাকা আদায়ে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে মামলা করেছে ব্যাংক দুটি। বর্তমানে মামলাগুলো চলমান রয়েছে।

আজিজ পাইপস জানায়, কোম্পানির উৎপাদিত পণ্যের প্রধান উপাদান কাঁচামাল সরবরাহ না থাকায় উৎপাদন বন্ধ আছে। কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাস প্রার্দূভাব ও পরবর্তীতে বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে উৎপাদনে প্রভাব পড়েছে। চলতি মূলধনের অভাবে কাঁচামাল ক্রয়ের ও সরবরাহ ব্যাহত হয়। ব্যাংকগুলির সাথে অমীমাংসিত ঋণের সমস্যার কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। ২০২১ সালের ৮ নভেম্বর থেকে কিছুদিন উৎপাদন বন্ধ থাকার পর পুনরায় স্থানীয় বাজার থেকে তুলনামূলক বেশী দরে কাঁচামাল ক্রয় করে উৎপাদন চালু রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। সরবরাহকারী বাকিতে কাঁচামাল সরবরাহে অপারগতা প্রকাশ করায় বর্তমানে উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
আজিজ পাইপস-এর কোম্পানি সচিব মো. রেজাউল ইসলাম বলেন, গত বছরের (২০২৪) পহেলা মে থেকে কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। কোম্পানি ঋণ খেলাপী হওয়ায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সুবিধা পাচ্ছে না। ব্যাংকগুলির সাথে আলোচনা অব্যাহত আছে এবং ঋণ পুনঃতফসিলকরনের জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আর্থিক সুবিধা পেলে কোম্পানি নিজস্ব উদ্যোগ এলসি খুলে কাঁচামালের যোগান নিশ্চিত করবে।
ডাচ বাংলা ব্যাংকের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মো. শহিদ উল্লাহ্ বলেন, আজিজ পাইপস কিছু টাকা দিয়েছে। কোম্পানিটি ব্যাংকের পাওনার অধিকাংশ টাকাই পরিশোধ করেনি এখনো। ইতিমধ্যে কোম্পানিটি ঋণ খেলাপিগ্রস্ত হয়েছে। ঋণ খেলাপির দায়ে আমরা অর্থ ঋণ আদালতে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করেছি। মামলা এখন চলমান রয়েছে। অ্যাসেট বিক্রি করে হলেও আমাদের টাকা পরিশোধ করতে হবে আজিজ পাইপসকে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রায় নয় মাস ধরে উৎপাদন বন্ধ থাকলেও কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে কারসাজি থেমে নেই। গত ছয় মাসের মধ্যে শেয়ার দর ৮০ টাকা ২০ পয়সা পর্যন্ত উঠেছিল। শেয়ারের এই দর বৃদ্ধিতে বেশি লাভবান হয়েছেন শেয়ার কারসাজিকারকদের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা পরিচালকরা। কারণ উচ্চ দামে শেয়ার বিক্রি করে কোম্পানিটি থেকে বিনিয়োগের চেয়ে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করেছেন উদ্যোক্তা পরিচালকরা। আর এসমস্ত শেয়ার বেশি দামে কিনে বিপাকে রয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীর। শেয়ার তারা না পারছেন বিক্রি করতে, না পারছেন ধরে রাখতে।
বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বিজনেস আই বাংলাদেশকে বলেন, যেকোনো কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ শেয়ার ব্লক মডেলে থাকে। অর্থাৎ এই ৩০ শতাংশ শেয়ার কোনোভাবেই সেই কোম্পানি বিক্রি করতে পারবে না। এক্ষেত্রে কিভাবে আজিজ পাইপস শেয়ারগুলো বিক্রি করলো তা আমার জানা নেই। তবে আমি বিষয়টি কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানাবো।
ডিএসই সূত্রে জানা যায়, ৩০ জুন, ২০২২ তারিখে কোম্পানিটিতে উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার ধারন ছিল ২৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এক বছর পর ৩০ জুন, ২০২৩ তারিখে উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৪৯ শতাংশে। আর সর্বশেষ ৩০ নভেম্বর, ২০২৪ তারিখে উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার ধারণ এসে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ১৬ শতাংশ।
আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে জানা গেছে, ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে লেনদেন করা আজিজ পাইপস ২০২১ সাল থেকে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দিচ্ছে না। ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে ০ দশমিক ৮২ টাকা, ২০২২ সালে ৪ দশমিক ৫৪ টাকা, ২০২৩ সালে ৬ দশমিক ৮৭ টাকা এবং ২০২৪ সালে ৬ দশমিক ০৩ টাকা। আর প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২৪) শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে ০ দশমিক ৮২ টাকা, এর আগের বছরের একই সময়ে লোকসান ছিল ১ দশমিক ০১ টাকা। কোম্পানিটির পুঞ্জীভূত লোকসান রয়েছে ৩৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
উল্লেখ্য, আজিজ পাইপস এর মোট শেয়ার সংখ্যা ৫৩ লাখ ৪৭ হাজার ১২৫টি, যার মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার রয়েছে ৮১ দশমিক ১২ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ এবং উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে রয়েছে ১১ দশমিক ১৬ শতাংশ।