ড. নুসরাত হাফিজ
সহকারী অধ্যাপক এবং পরিচালক, উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট সেল (WEC), ব্র্যাক বিজনেস স্কুল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
কল্পনা করুন এক পৃথিবী, যেখানে নারীরা সমান সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, তাদের নেতৃত্ব অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং তারা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। এই স্বপ্ন কেবল কল্পনা নয়; এটি একটি অপরিহার্য প্রয়োজন। দক্ষতা, সম্পদ ও নেটওয়ার্কে লিঙ্গ সমতা অর্জন মানবাধিকারের বিষয় হওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে অপরিহার্য। ম্যাককিন্সি গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উদ্যোক্তায় লিঙ্গবৈষম্য দূর করা সম্ভব হলে ২০২৫ সালের মধ্যে বৈশ্বিক জিডিপি ১২ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে।
তবে এই সমতার পথে রয়েছে অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা। ২০২২ সালের একটি ইউএন উইমেন রিপোর্ট বলছে, বিশ্বব্যাপী নারীদের স্টার্টআপ কার্যক্রম মাত্র ১০.১ শতাংশ এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবসার হার আরও কম, মাত্র ৫.৫ শতাংশ। এছাড়া, উইমেনস এমপাওয়ারমেন্ট ইনডেক্স (WEI) এবং গ্লোবাল জেন্ডার প্যারিটি ইনডেক্স (GGPI) অনুসারে, নারীরা তাদের সম্ভাবনার মাত্র ৬০ শতাংশ এবং পুরুষদের তুলনায় ৭২ শতাংশ অর্জন করতে সক্ষম। এই ২৮ শতাংশের লিঙ্গবৈষম্য কেবল সামাজিক সমস্যাই নয়; এটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বৈশ্বিক উদ্ভাবনে বাধা।
বাংলাদেশেও এ বৈষম্যের প্রতিফলন ঘটে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) সর্বশেষ হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (HIES) অনুযায়ী, নারীদের বেকারত্বের হার (৫.৯%) পুরুষদের তুলনায় দ্বিগুণ (২.৮%)। শহুরে নারীদের ক্ষেত্রে এই হার আরও বেশি, ৯.৬ শতাংশ। পাশাপাশি, মজুরির বৈষম্য আরও জটিল করে তুলেছে পরিস্থিতি; পুরুষরা নারীদের তুলনায় ঘণ্টায় গড়ে ৩৫.৮ শতাংশ বেশি উপার্জন করেন। এই চিত্র থেকে স্পষ্ট যে, দক্ষতার উন্নয়ন ও সম্পদে নারীদের ক্ষমতায়ন ছাড়া, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ৩৪ কোটিরও বেশি নারী ও কন্যাশিশু চরম দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
কিন্তু যেখানে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেখানেই রয়েছে সম্ভাবনা। নারীদের ক্ষমতায়ন এখন আর বিকল্প নয়; এটি একটি উন্নত, উদ্ভাবনী এবং টেকসই ভবিষ্যতের মূল চাবিকাঠি। উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৫ (SDG 5) অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট সেল (WEC) দক্ষতা বৃদ্ধি, সম্পদ প্রদান এবং নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করছে।
WEC-এর রূপান্তরমূলক উদ্যোগ উদ্যামী আমি নারীভিত্তিক প্রতিবন্ধকতা দূর করতে এবং নারীদের আত্মনির্ভরশীল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে নিরলসভাবে কাজ করছি। ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি, ডিজিটাল মার্কেটিং এবং আইনি জ্ঞানের মতো কোর্সগুলোতে ব্যবহারিক দক্ষতা শেখানো হয়। পাশাপাশি, নেটওয়ার্কিং ইভেন্টের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীদের শিল্প নেতাদের সঙ্গে যুক্ত করা হয় এবং ব্যাংক ঋণসহ আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়। প্রোগ্রামের ফলাফল তার সফলতার বড় প্রমাণ। ২০২০ সালে শুরু হওয়া এই কর্মসূচির মাধ্যমে সাতটি ব্যাচে ইতিমধ্যেই ১৪৪ জন নারী স্নাতক হয়েছেন। এটি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য নয়, সামাজিক রূপান্তরের জন্যও একটি মডেল তৈরি করছে।
নারীর ক্ষমতায়ন আমাদের সকলের দায়িত্ব। দক্ষতা উন্নয়ন কর্মশালার অর্থায়ন, ফ্ল্যাগশিপ প্রোগ্রামের পৃষ্ঠপোষকতা, বা নতুন উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে—প্রত্যেকটি অবদান একটি উন্নত আগামী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সঠিক অর্থায়ন এবং সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা WEC-এর প্রভাবকে টেকসই ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত করতে পারে। নারীরা উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে গেলে একটি জাতি নতুন সম্ভাবনা ও টেকসই প্রবৃদ্ধির দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।