নিজস্ব প্রতিবেদক
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানি এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের প্রায় আট মাস ধরে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। বিষয়টি গোপন রেখেছে কোম্পানির বর্তমান কর্তৃপক্ষ। ফলে প্রতিষ্ঠানটির সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এ সংক্রান্ত কোনো তথ্যই জানে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সরেজমিনে জানা গেছে, ঢাকা থেকে ১৭০ কিলোমিটার দূরে শেরপুর সদরের শেরিপাড়ায় প্রতিষ্ঠানটির কারখানা। রাস্তার ধারে প্রায় জনমানবহীন এলাকায় কারখানাটির অবস্থান। উৎপাদন বন্ধ থাকায় সেখানে নেই কোনো কোলাহল। প্রায় আট মাস আগেও যে কারখানা শত শত শ্রমিকের পদচারণায় মুখরিত থাকতো, সেটি এখন প্রায় মানবশুন্য এতিমের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমানে গুটি কয়েক নিরাপত্তা প্রহরী ও স্টাফের বসবাস সেখানে। কারখানার আশেপাশেও নেই তেমন বাড়িঘর, আছে দূরে দূরে। কারখানার পাশে হাতেগোনা কয়েকটি দোকান থাকলেও, কারখানা বন্ধ থাকায় নেই তেমন বিকিকিনি। ফলে দোকানদারা শুয়ে বসে অনেকটা অলস সময় পার করছেন। কারখানায় উৎপাদন থাকাকালিন শ্রমিকরা এসব দোকানেই খেতেন চা, বিস্কুট, পানসহ অন্যান্য পণ্যসামগ্রী। কারখানার বাহিরে শ্রমিকরা দিনের একটা সময় কিছুটা অবসর সময় কাটাতেন। এখন সেখানে রাখাল গরু বেধে রেখেছে, ঘাস খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে।

সরেজমিন ঘুরে আরও জানা গেছে, যেসব মেশিন আর লোহা লক্করের টুংটাং শব্দে মুখরিত থাকতো কারখানিটি, সেসব মেশিনারিজ স্থবির অবস্থায় পড়ে আছে। এভাবে মেশিনারিজ দীর্ঘদিন পড়ে থাকলে অচিরেই সেগুলোর কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে। এতিমের যেমন অভিভাক নেই, তেমনি কারখানাটিরও যেন কোনো অভিভাবক নেই। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ১৪ থেকে ১৫ একর জায়গা জুড়ে কারখানার অবস্থান। কারখানায় ৪০০ থেকে ৫০০ জন শ্রমিক কাজ করতেন। তাদেরক সকলকে ছাঁটাই করা হয়েছে। শ্রমিকদের পদচারণায় যেমন কারখানাটি মুখরিত থাকতো, তেমনি থাকতো কারখানার বাহিরের অংশও। কারখানার বর্তমান মালিক গ্যাস সরবরাহ ঠিকমতো না করায় কারখানাটি বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি শ্রমিক বান্ধব নন।
এদিকে এমারেল্ড অয়েলের উৎপাদন বন্ধ থাকলেও এ সংক্রান্ত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য (পিএসআই) দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-ডিএসইকে জানায়নি প্রতিষ্ঠানটি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানিটি ডিএসইর রুলস ভঙ্গ করেছে। এবিষয়ে জানতে এমারেল্ড অয়েলের কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ জাইদুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কোনো উত্তর দেয়নি। এমনকি মোবাইলে ম্যাসেজের মাধ্যমে জানতে চাওয়া হলেও, তিনি কোনো উত্তর দেননি।
ডিএসই’র লিস্টিং অ্যাফেয়ার্স বিভাগের ম্যানেজার রবিউল বিজনেস আই বাংলাদেশকে বলেন, এমারেল্ড অয়েলের কারখানা বন্ধের বিষয়টি আমাদের জানা নেই। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, কর্পোরেট পরিচালক হিসেবে মিনোরি বাংলাদেশের কাছে বর্তমানে এমারেল্ড অয়েলের ৩ কোটি ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ৫০৪টি শেয়ার রয়েছে। মিনোরি বাংলাদেশের কর্ণধার মিয়া মামুন-এর জন্ম বাংলাদেশে।বাংলাদেশ থেকে জাপানে গিয়ে সেখানকার নাগরিকত্ব নেন। এরপর আবার তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। জাপানের প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পাওয়া মিনোরি বাংলাদেশ আসলে সে দেশের প্রতিষ্ঠান না। এটি মূলত মিয়া মামুনের নিজের প্রতিষ্ঠান। জাপানে এর কোনো কার্যক্রম নেই।
বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রতারণা করতেই মিনোরি বাংলাদেশকে জাপানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন মিয়া মামুন ও তার দোসররা। আর এ কাজে সরাসরি মিয়া মামুনকে সহযোগিতা করেছে সাবেক শিবলী কমিশন।
জানা গেছে, মিনোরি বাংলাদেশ জাপানের হলে সেই দেশের সরকারের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া যেতো। কিন্তু আদৌ প্রতিষ্ঠানটিতে জাপান সরকারের কোনো সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। মিনোরি বাংলাদেশকে জাপানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে কার্যত সেই দেশটিকে বিনিয়োগকারীদের কাছে বিতর্কিত করেছে মিয়া মামুন ও তার দোসররা। এমারেল্ড অয়েলকে অধিগ্রহণ করেই লভ্যাংশের নাটক সাজিয়ে শেয়ার কারসাজিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মিয়া মামুনের মিনোরি বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে তার প্রমাণও পাওয়া গেছে। চলতি বছরে উচ্চ দামে একাধিকবার শেয়ার বিক্রি করে বিশাল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে মিয়া মামুন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন- বিএসইসি’র সাবেক শিবলী কমিশনের ছত্রছায়ায় এমারেল্ড অয়েলকে অধিগ্রহণ ও শেয়ার কারসাজি করে মিনোরি বাংলাদেশ। এই শিবলী কমিশনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মিনোরি বাংলাদেশ গত বছরের (২০২৩) ১৩ জুলাই কারসাজি করে এমারেল্ড অয়েলের শেয়ার দর ১৮২ টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত উঠিয়েছিল।
জানা গেছে, মিনোরি বাংলাদেশ লিমিটেড ২০২১ সালে এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে অধিগ্রহণ করে। অধিগ্রহণ করে ২০২২ সালে বিনিয়োগকারীদের নামমাত্র লভ্যাংশ প্রদান করে এমারেল্ড অয়েল। আর ২০২৩ সালে বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ লভ্যাংশ প্রদান করে। মূলত শেয়ারের দাম উর্ধ্বমুখি করতেই এই লভ্যাংশ প্রদান করে মিনোরি বাংলাদেশ। মাঝখান থেকে বেশি দামে শেয়ার কিনে সর্বশান্ত হয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা, জানান বাজার বিশ্লেষকরা।
ডিএসইর তথ্য মতে, চলতি বছরের (২০২৪) মার্চে ৬৬ টাকা ৯০ পয়সা থেকে ৭০ টাকা ৪০ পয়সার মধ্যে ১০ লাখ শেয়ার বিক্রি করেছে মিয়া মামুনের মিনোরি বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠানটি এই শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেয় ১৪ মার্চ। আর শেয়ার বিক্রি সম্পন্ন করে ২১ মার্চ। এরপর সপ্তাহ না পেরোতেই ২৫ মার্চ প্রতিষ্ঠানটি আবারো ৩৬ লাখ ৬৬ হাজার ৫০০টি শেয়ার বিক্রি করার ঘোষণা দেয়। এপ্রিল মাসের ৮ তারিখের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো ৫৮ টাকা ১০ পয়সা থেকে ৬৭ টাকা ১০ পয়সার মধ্যে শেয়ারগুলো বিক্রি করে দেয় মিনোরি বাংলাদেশ।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, মিয়া মামুনের এমন ঘন ঘন শেয়ার বিক্রিই বলে দেয় এমারেল্ড অয়েলকে নিয়ে কোনো ইতিবাচক ভাবনা নেই তার মধ্যে। উচ্চ দামে শেয়ার বিক্রি করার উদ্দেশ্যেই মূলত এমারেল্ড অয়েলকে অধিগ্রহণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
কোম্পানির আর্থিক চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত এক বছরে এমারেল্ড অয়েলের শেয়ার দর সর্বনিম্ন ১৮ টাকা ৬০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ১১৬ টাকা ৩০ পয়সা পর্যন্ত উঠেছিল। সোমবার (১৮ নভেম্বর) প্রতিষ্ঠানটির সমাপনি শেয়ার দর ছিল ২৫ টাকা ৪০ পয়সা। ৩০ জুন ২০২৩ হিসাব বছরের পূর্বের পরিচালকদের কাছে থাকা ২৯ দশমিক ৯২ শতাংশ শেয়ার বাদ দিয়ে ১০ শতাংশ লভ্যাংশ প্রদান করে এমারেল্ড অয়েল। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি বিনিয়োগকারীদের ৬ কোটি ৩৯ লাখ ৬৩ হাজার ৪২০ টাকা লভ্যাংশ প্রদান করে। আর পরবর্তীতে উচ্চ দামে শেয়ার বিক্রি করে লভ্যাংশ প্রদানের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অর্থ বাজার থেকে তুলে নেয় মিনোরি বাংলাদেশ।
শেয়ারবাজারে বিতকির্ত মিয়া মামুন পুঁজিবাজারে আরেক কোম্পানি ফু ওয়াং ফুড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। গত ৩০ সেপ্টেম্বর এক প্রতারণা মামলায় তিনি আটক হয়েছেন। বর্তমানে তিনি জামিনে মুক্ত আছেন। যেকোনো সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে দেশ ত্যাগ করতে পারেন বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে জামালপুরের সৈয়দ হাসিবুল গনি গালিব শেরপুর শহরের শেরীপাড়ায় গড়ে তোলেন এমারেল্ড অয়েল কারখানা। ২০১১ সালে স্পন্দন-ব্র্যান্ডেড রাইস ব্র্যান অয়েল উৎপাদন শুরু করে। ২০১৪ সালে কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে ২০ কোটি টাকা তোলে। প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাবে ২০১৭ সালে কোম্পানিটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বেসিক ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে দুদকের মামলায় জেলে যেতে হয় গনিকে। দীর্ঘদিন জেলে থাকার পর জামিনে মুক্তি পেয়ে দেশের বাইরে চলে যান তিনি।
এরপর এমারেল্ড অয়েলের মালিকানা নেওয়ার পরে মিনোরি বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনায় ২০২২ সালের জানুয়ারিতে পুনরায় কোম্পানিটির উৎপাদন শুরু হয়েছিল। কোম্পানির অনুমোদিত মূলধন একশো কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ৯১ কোটি ২৭ লাখ ২০ হাজার টাকা।