পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। বিবিধ খাতের কোম্পানিটির অধিগ্রহণ নাটক যেন থামছেই না। অধিগ্রহণ নাটকের অংশ হিসেবে এবার কোম্পানিটি বিকন ফার্মাসিউটিক্যালসকে জড়িয়েছে। এর আগে জড়িয়েছিল বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ককে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্রটি জানায়, খান ব্রাদার্সকে বিএসবি ক্যামব্রিয়ান এডুকেশন গ্রুপ অধিগ্রহণ করার কথা ছিল। প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত বিএসবি গ্রুপের সাথে চুক্তি করে খান ব্রাদার্স। কিন্তু বিএসবি ক্যামব্রিয়ানের চেয়ারম্যান খায়রুল বাশার বাহার পালিয়ে যাওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানটির সাথে চুক্তি বাতিল করে খান ব্রাদার্স।হাজার হাজার মানুষের বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন ভঙ্গ করে টাকা নিয়ে পালিয়ে য়ায় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান। ফলে সেই চুক্তি থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় খান ব্রাদার্স।
অনুসন্ধানে জানা গছে, উৎপাদন বন্ধ থাকা খান ব্রাদার্স দীর্ঘদিন ধরে শেয়ার কারসাজির সাথে জড়িত। কারসাজিরকারকদের সাথে হাত মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটি তাদের শেয়ার দর দুইশো টাকার উপরে উঠিয়েছিল। বর্তমানেও প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার অতিমূল্যায়িত অবস্থায় রয়েছে। শুকনো কথায় যেহেতু চিড়া ভিজে না। তাই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ারটির প্রতি আকৃষ্ট করতে এই অধিগ্রহণের নাটক সাজায় খান ব্রাদার্স। যাতে করে বিনিয়োগকারীরা অধিগ্রহণের খবর শুনে খান ব্রাদার্সের শেয়ার উচ্চ দামে কিনে নেয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, খান ব্রাদার্সের মতো বাটপার প্রতিষ্ঠান বিএসবি ক্যামব্রিয়ান এডুকেশন গ্রুপও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএসবি ক্যামব্রিয়ান এডুকেশন গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক। প্রতিষ্ঠানটি হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তাদের বিদেশে পাঠানোর নাম করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তাদের উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠায়নি বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক।
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় গুলশানের অফিস বর্তমানে তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যানসহ কারো সাথেই যোগাযোগ করতে পারছেন না। অর্থের অভাবে তাদের ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠাতে পারছে না। বর্তমানে ক্যামব্রিয়ান এডুকেশন গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা মো. খায়রুল বাশার পলাতক রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করেছেন এসব শিক্ষার্থী। তার বিরুদ্ধে প্রতারণামূলক একাধিক মামলাও করেছেন তারা।
জানা গেছে, এমনিতেই খান ব্রাদার্স একটি লোকসানি ও বাটপার প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিনিয়োগকারীদের কাছে পরিচিত। আবার বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক প্রতারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে সবার কাছে। এমন বাটপার প্রতিষ্ঠান আরেক বাটপার প্রতিষ্ঠানকে অধিগ্রহণ করবে, এমন খবরে বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিততো হয়ইনি, বরং তারা খান ব্রাদার্সের প্রতি আরও অসন্তুষ্ট হয়েছেন।
এদিকে বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের সাথে অধিগ্রহণ চুক্তি বাতিল করে বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস পিএলসির সাথে নতুন করে চুক্তি করেছে খান ব্রাদার্স। গত ৪ নভেম্বর প্রতিষ্ঠান দুটির মধ্যে নতুন সমঝোতা চুক্তি সই হয়েছে, যা গতকাল (১০ নভেম্বর) ডিএসইতে নিউজ আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এখন নতুন কারসাজিতে যুক্ত হয়েছে বিকন গ্রুপ। দীর্ঘদিন ধরে লসে থাকা কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের সর্বস্বান্ত করার পায়তারা করছে।
মূলত অতি মূল্যায়িত শেয়ার খান ব্রাদার্স ও তার কারসাজিকারকরা বিক্রি করতে পারছে না দীর্ঘদিন ধরে। এই শেয়ারকে কোনো রকমে বিনিয়োগকারীদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাদের সর্বশান্ত করাই খান ব্রাদার্স ও তার দোষরদের মূল লক্ষ্য বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
তথ্য অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, গত এক বছরে বা ৫২ সপ্তাহে খান ব্রাদার্সের শেয়ার দর সর্বনিম্ন ৫৩ টাকা থেকে সবোর্চ্চ ২৩৯ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। শেয়ারটি নিয়ে কারসাজি এখনো চলমান। বিগত বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এর শিবলী কমিশন ও ডিএসইর একাধিক কর্মকর্তা এই শেয়ারটির কারসাজির সাথে জড়িত। যে কারণে দীর্ঘদিন ধরে কারসাজি হলেও শিবলী কমিশন ও ডিএসই শেয়ারটির কারসাজিকারকদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বর্তমানেও ডিএসইর কিছু অসাধু কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ মদদে খান ব্রাদার্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজি হচ্ছে। যেকারণে ডিএসই এব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।
২০২০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে লোকসান করেছে খান ব্রাদার্স। গত বছর (৩০ জুন ২০২৪) নামমাত্র ০ দশমিক ০১ টাকা শেয়ারপ্রতি আয় দেখিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এই আয় নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বর্তমানে উৎপাদন বন্ধ থাকা খান ব্রাদার্সের শেয়ার দর অনেক ফান্ডামেন্টাল কোম্পানির শেয়ার দরের চেয়ে বেশি। নিঃসন্দেহে এই শেয়ারটি নিয়ে এখনো কারসাজিকারকরা তৎপর রয়েছে। তাই বিনিয়োগকারীদের এব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
উল্লেখ্য, পুঁজিবাজারে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে লেনদেন করা খান ব্রাদার্সের আজ (১১ নভেম্বর) ডিএসইতে সমাপনী দর ছিল ১৬২ টাকা ৪০ পয়সা। ৩০ জুন, ২০২৪ সমাপ্ত হিসাববছরে কোম্পানিটি সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন ১৫০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ৯৮ কোটি টাকা। ৩০ জুন হিসাব বছরের কোম্পানিটির বর্তমানে শেয়ার রয়েছে ৯ কোটি ৮০ লাখ ৭৯ হাজার ৮৭৭টি, যার মধ্যে ৩১ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার এসে দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ১৩ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ৬০ দশমিক ৫৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।