গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উর্ধ্বতন পদে কর্মরত অনেকেই পদত্যাগ করলেও বহাল তবিয়তে আছেন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ-আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবুল হোসেন। অথচ আবুল হোসেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগদানের পর ঋণখেলাপি, উৎপাদন বন্ধ ও ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে সমালোচিত হয়েছে আইসিবি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজারের কারসাজিকারকদের সহায়ক হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আবুল হোসেন আইসিবিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেননি। কারসাজিকারকদের শেয়ার উচ্চমূল্যে কিনে আইসিবিকে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। আইসিবিকে বর্তমান ভঙ্গুর অবস্থায় আনতে এমন কোনো কাজ নেই যা তিনি করেননি।
এদিকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এর চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম, ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, আইসিবির চেয়ারম্যান সুবর্ণ বড়ুয়া, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান পদত্যাগ করলেও বহাল তবিয়তে আছেন আবুল হোসেন। তিনি তার পদ ধরে রাখার জন্য তদবির করে যাচ্ছেন। এই অপদার্থ, অযোগ্য, চাটুকার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে আর একদিনেও আইসিবিতে দেখতে চায় না সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। অনতিবিলম্বে তাকে পদত্যাগের দাবি জানান তারা।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, আইসিবিকে অব্যবস্থাপনা ও লোকসানে নিমজ্জিত করে নিজে ফরমায়েসি জীবন পরিচালনা করছেন আবুল হোসেন। প্রতিষ্ঠানে সঠিক কাঠামো বলতে কিছু নেই। এই আবুল হোসেন পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আইসিবি সঠিক কাঠামোতে আসবে না।
তারা আরো জানান, পুঁজিবাজারকে গতিশীল করতেই মূলত আইসিবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন সেই আইসিবিই গতিহীন হয়ে পড়েছে। এমন একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক গত পাঁচ বছর ধরে কাজ করছেন, যিনি দলীয়করণের বাহিরে কিছু চিন্তা করতে পারেন না। হাসিনা সরকারের সরাসরি মদদপুষ্ট আবুল হোসেন পদ বাণিজ্য করেছেন। বিভিন্নজনকে অর্থের বিনিময়ে পদন্নতি দিয়েছেন তিনি। আইসিবিকে গতিশীল করতে হলে সৎ, কর্মঠ ব্যক্তিকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া উচিত।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২১ শে আগস্ট ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আইসিবি-তে যোগদান করেন আবুল হোসেন। শেয়ারবাজারের তারল্য সংকট দূর করে চাঙ্গা করাই আইসিবির মূল কাজ। কিন্তু তা করতে সম্পূর্ণরুপে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গত পাঁচ বছর ধরে শেয়ারবাজারে তারল্য সংকট রয়েছে মারাত্মকভাবে। আর ঋণ নিয়ে বাজারকে সহযোগিতা করার পরিবর্তে নিম্নমানের শেয়ারে বিনিয়োগ করে বাজারকে যেমন ধ্বংস করেছে, তেমনি ধ্বংস হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি নিজেও। এসবের দায় আবুল হোসেন কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।
এদিকে আইসিবি দিন দিন ভঙ্গুর হয়ে পরলেও নিজের বেতন-ভাতা থেকে শুরু করে সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা ঠিকই নিচ্ছেন আবুল হোসেন। তার বিরুদ্ধে দুর্বল শেয়ারে আইসিবিকে বিনিয়োগে চাপ দেয়া, পদ বাণিজ্যসহ নানারকম অভিযোগ থাকলেও বিদায়ী সরকারের ঠিকই আস্থাভাজন ছিলেন তিনি। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের চাওয়া, শেয়ার বাজারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিরা যেমন পদত্যাগ করেছেন, তেমনি আবুল হোসেনেরও উচিত পদত্যাগ করা। কারণ তিনি হাসিনা সরকারের দোসর হিসেবে ইতিমধ্যে সর্বজন পরিচিত। তিনি নিজে পদত্যাগ না করলে জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো উচিত।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমান আবুল হোসেনের মেয়াদে আইসিবির কোনো উন্নতি হয়নি। বরং গত পাঁচ বছরে ধারাবাহিকভাবে অবনতি হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। যেখানে রক্ষকের ভুমিকায় অবতীর্ণ হওয়া উচিত ছিলো, সেখানে আবুল হোসেনের নেতৃত্বে আইসিবি ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে অনেক বিনিয়োগকারীই নিঃস্ব হয়েছেন।
তথ্যানুসন্ধানে আরো জানা গেছে, বছরের ব্যবধানে কোম্পানির শেয়ার দর কমেছে ২৬ শতাংশ। কোম্পানির সর্বশেষ শেয়ার দর এসে দাঁড়িয়েছে ৬৪ টাকা ৯০ পয়সা। সর্বশেষ হিসাব বছরে (৩০ জুন ২০২৩) দীর্ঘমেয়াদি লোন এসে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৭৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।
কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ হিসাব বছরে কম ডিভিডেন্ড দেয়ায় ক্যাটাগরির অবনতি হয়েছে। পাঁচ শতাংশ, অর্থাৎ আড়াই শতাংশ ক্যাশ ও আড়াই শতাংশ বোনাস ডিভিডেন্ড দেয়ায় ‘এ’ ক্যাটাগরি থেকে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তরিত হয়েছে। এতে করে শেয়ারের দামও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। ফলে লোকসানে পড়েছে বিনিয়োগকারীরা। গত তিন প্রান্তিকে (জুলাই ২০২৩- মার্চ ২০২৪) শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে ৩ টাকা ০৮ পয়সা।
এদিকে ঋণের পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়ালেও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ঘাড়ে এর দায় এখনো দেয়া হয়নি। চেয়ারম্যান সুবর্ণ বড়ুয়া পদত্যাগ করলেও বহাল তবিয়তে আছেন আবুল হোসেন। আবুল হোসেনের ভাবটা এমন যেন সব দোষ চেয়ারম্যানের, তার কোনো দোষ নেই।
সাধারণ বিনিয়োগকারীরা জানান, আবুল হোসেনের কার্যক্রম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখা উচিত। তাকে শাস্তির আওতায় আনা উচিত।
বাজার বিশ্লেষকরা জানান, আইসিবির ভূমিকা ও বিনিয়োগ নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। অতীতে ব্যক্তিস্বার্থ ও কারসাজিকারীদের সঙ্গে মিলে সংস্থাটি এমন কিছু বিনিয়োগ করেছে, যে কারণে মূলধন সংকটে পড়তে হয়েছে। সংস্থাটির বিপুল বিনিয়োগ বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারে আটকে আছে। অতীতে আমরা দেখেছি, আইসিবির বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো স্বচ্ছতা ছিল না। সংস্থাটির বিনিয়োগের বড় অংশই ছিল প্রশ্নসাপেক্ষ। কখনো কখনো ব্যক্তি বিশেষকে সুবিধা দিতে চড়া দামে বাজে কোম্পানির শেয়ার কিনে সংস্থাটিকে বিপুল লোকসান গুনতে হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের এসব অনৈতিক কাজের দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না আবুল হোসেন।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বিজনেস আই বাংলাদেশকে বলেন, ঋণ করে বাজে কোম্পানির শেয়ার কেনা উচিত হয়নি আইসিবির।
আইসিবির বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংস করা হয়েছে। এই আইসিবিতে এখন আর কিছু করার নেই। এটা একটি ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
উল্লেখ্য, আইসিবির অনুমোদিত মূলধন এক হাজার কোটি টাকা, পরিশোধিত মূলধন ৮৬৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা। মোট শেয়ার সংখ্যা ৮৬ কোটি ৭২ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬১টি, যার মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার রয়েছে ৬৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ, সরকারি ২৭ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ১ দশমিক ৫৭ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।