নিজস্ব প্রতিবেদক
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত খাদ্য- আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানি তৌফিকা ফুডস অ্যান্ড লাভেলো আইসক্রিম পিএলসি। কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে আবারও কারসাজি হচ্ছে বলে সন্দেহ করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বর্তমানে শেয়ারটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি কোম্পানিটি আইসক্রিম প্ল্যান্টের ২য় ইউনিট স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে। অস্বাভাবিক শেয়ার দর বৃদ্ধির মাঝেই কোম্পানির এধরনের মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশে কারসাজিতে কোম্পানিটির যোগসাজশের বিষয়টি সামনে উঠে আসছে। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কারসাজি করে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ইচ্ছেমতো বাড়ানো হয়েছে। লাভেলো আইসক্রিমের শেয়ারের দাম মাত্র কয়েক মাসে এতটাই বেড়েছে যে এখন এটির শেয়ারে বিনিয়োগ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলে গেছে।
প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে ২০২১ সালে পুঁজিবাজার থেকে ৩০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে লাভেলো। লাভেলোর ভাষ্য অনুযায়ী সংগ্রহ করা টাকায় যন্ত্রপাতি, ফ্রিজ, যানবাহন কেনা, ডিপোতে বিনিয়োগ করে। ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণও পরিশোধ করে। যদিও বর্তমানে কোম্পানির ব্যাংক লোন রয়েছে ৬৮ কোটি টাকা।
আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে তালিকাভুক্তির সময় কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ছিলো ১ টাকা ৪১ পয়সা। ২০২২ সালে ছিলো ১ টাকা ৪৩ পয়সা, ২০২৩ সালে ১ টাকা ২৪ পয়সা ছিলো। আর সর্বশেষ ২০২৪ সালে এসে ইপিএস দাঁড়িয়েছে ১ টাকা ৪৩ পয়সা। পাশাপাশি তালিকাভুক্তির সময় শেয়ার ছিল ১৩ টাকা। আর গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে শেয়ারটির দর সর্বোচ্চ ১০৮ পর্যন্ত উঠিছিল। সেক্ষেত্রে শেয়ারটির দর সর্বোচ্চ ৭৩১ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল। এদিকে শেয়ার দর এতো বেশি বৃদ্ধি পেলেও তাদের একই সময়ে ইপিএস বেড়েছে মাত্র ০২ পয়সা। কারসাজি করে শেয়ার দর বাড়াতে পারলেও কাঙ্খিত ইপিএস বাড়াতে পারেনি কোম্পানি। বরঞ্চ শেয়ার দরের উর্ধ্বমুখিতা ধরে রাখার জন্য কোম্পানি নানা রকম ছলচাতুরির আশ্রয় নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানা যায়, চলতি বছরের শুরুর দিকে একটি চক্র লাভেলো আইসক্রিমের শেয়ার নিয়ে কারসাজি শুরু করে। সেসময় কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বাড়ানোর সঙ্গে জড়িত কারসাজিকারকেরা নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে গোপন সহায়তা পেয়েছেন বলে অভিযোগ ছিলো। এদিকে ২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির প্রথম সপ্তাহেই প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার নিয়ে কারসাজির অভিযোগ উঠে। আর চলতি বছরের শুরুতে কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে কারসাজির ঘটনা ছিল অনেকটা ওপেন সিক্রেট।
কারসাজিকারকেরা বাজারে এই শেয়ারকে সেই সময় শিবলী কমিশনের ‘আইটেম’ হিসেবেও প্রচার করে। অর্থাৎ শিবলী কমিশন সরাসরি এই শেয়ারের কারসাজির সাথে জড়িত ছিলো বলে অভিযোগ রয়েছে। যেহেতু শুকনো কথায় চিড়া ভিজবে না। তাই আইসক্রিম উৎপাদনের খবর ছড়িয়ে, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ধরিয়ে দেয়ার ধান্দা-ফিকির করছে কোম্পানিটি। বিনিয়োগকারীদের আবারো পথে বসাতে চাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। আইসক্রিমের নতুন প্ল্যন্ট স্থাপনের লোভ দেখিয়ে শেয়ারটি বিনিয়োগকারীদের উচ্চ দামে ধরিয়ে দেওয়ার অংশ হিসেবে দেখছেন তারা।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় সর্বশেষ ৩০ জুন, ২০২৪ তারিখে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ মূল্য দাঁড়িয়েছে ১৩ টাকা ৩৭ পয়সা। তালিকাভুক্ত হওয়ার সময় যা ছিলো ১২ টাকা ৭৫ পয়সা। সাড়ে তিন বছরে এনএভি বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র চার শতাংশ। অথচ শেয়ারটির সর্বশেষ দর এসে দাঁড়িয়েছে ৯৪ টাকা ২০ পয়সা। সঠিক পন্থায় এই শেয়ারের এতো বেশি দর বৃদ্ধি হওয়ার কোনো কারণ নেই। গত দুই বছর আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের ১৮ অক্টোবর কোম্পানির শেয়ার দর ছিলো ৩৯ টাকা। এক্ষেত্রে দুই বছরের ব্যবধানে শেয়ার দর বেড়েছে ১৪৮ শতাংশ।
গত ১০ মাসে কোম্পানির কাছে ইতিমধ্যে দুই বার অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)।
খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, এই প্ল্যান্ট উৎপাদনে আসার পর মুনাফা করতে কমপক্ষে দুই থেকে তিন বছর লেগে যাবে। আপাতত এই শেয়ার কিনে বিনিয়োগকারীদের কোনো লাভ নেই। আর আদৌ কোম্পানি এই প্ল্যান্ট স্থাপন করে ব্যবসা বাড়াতে পারবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের প্রতারণার জালে ফেলতেই লাভেলো এ ধরনের মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করেছে। ইতিমধ্যেই শেয়ারটি বিপদজনক হওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শেয়ারটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, লাভেলোর বর্তমানে শেয়ার প্রতি নিরীক্ষিত পিই রেশিও ৭৮ দশমিক ১৫ পয়েন্ট। আর অনিরীক্ষিত পিই রেশিও ৫৬ দশমিক ৭৮ পয়েন্ট। পিই রেশিওতেই বোঝা যায় কোম্পানির শেয়ার ঝুঁকিপূর্ণ। কোনোভাবেই এই শেয়ার দিয়ে মার্জিন লোন নিতে পারবে না বিনিয়োগকারীরা। কারণ যেকোনো শেয়ারে মার্জিন লোন নিতে হলে পিই রেশিও সর্বোচ্চ ৪০ পয়েন্ট হতে হয়।
ডিএসইর তথ্য মতে, গত এক মাসে লাভেলোর শেয়ার দর বেড়েছে ২১ শতাংশ। গত মাসের (সেপ্টেম্বর) ১৮ তারিখে শেয়ার দর ছিলো ৭৯ টাকা ৫ পয়সা। গত বুধবার (১৬ অক্টোবর) শেয়ারটি টপটেনের শীর্ষে ছিলো। ৩০ জুন, ২০২৩ হিসাব বছরে কোম্পানির প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ছিলো ১৯ দশমিক ৫১ শতাংশ। আর ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এসে দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এই সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ কমেছে ৮ শতাংশ।
জানা গেছে, লাভেলোর নতুন প্ল্যান্ট স্থাপনে ১৫০ কোটি টাকা খরচ হবে। এই অর্থ ব্যাংক ও কোম্পানি থেকে সংগ্রহ করবে। যেহেতু ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে প্ল্যান্ট স্থাপন করবে, সেহেতু বর্তমান মন্দাবাজারে প্রফিট করে ১২ শতাংশ সুদে এই টাকা পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে কোম্পানির জন্য। তাই এই প্ল্যান্ট স্থাপনের পর কোম্পানির লোনের পরিমাণ বাড়বে বই কমবে না, ধারণা বিশ্লেষকদের।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এর মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বিজনেস আই বাংলাদেশকে বলেন, লাভেলো ইনসাইডার ট্রেডিং করে দাম বাড়িয়ে থাকে কোম্পানির শেয়ারের লেনদেনের উপর সার্ভেল্যান্স করা হবে। যদি লেনদেনে ক্রাইম কিছু ধরা পরে, পাশাপাশি অসৎ উদ্দেশ্যে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রচার করে থাকে তবে কমিশন অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে। এটা শুধু লাভেলো না, যেকোনো কোম্পানির ক্ষেত্রে ক্রাইম কিছু পেলে কমিশন ব্যবস্থা শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। আর যেসব ব্রোকারেজ হাউজ এসব কাজে জড়িত তাদের ব্যাপারেও কমিশন অতিতেও ব্যবস্থা নিয়েছে। ভবিষ্যতেও নেবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর পরিচালক (রিসার্চ) গোলাম মোয়াজ্জেম জানান, বর্তমানে পুঁজিবাজার যেভাবে চলছে তাতে করে এই বাজার থেকে ভালো কিছু সম্ভব না। যেকোনো কোম্পানি বা ব্রোকারেজ হাউজ তাদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য যদি কোনো অসৎ পথ অবলম্বন করে, তবে অবশ্যই তাদেরকে বড় আকারে শাস্তি দিতে হবে। বর্তমান পুঁজিবাজারকে ঢেলে সাজাতে হবে। বড় আকারে সংস্কার করতে হবে। পুঁজিবাজার সংস্কারে বর্তমানে গঠিত টাস্কফোর্সকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। এই টাস্কফোর্স বাজারের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে, তা দীর্ঘমেয়াদী সমাধান করবে বলে আমি আশা করি।
এ বিষয়ে জানতে, লাভেলোর কোম্পানি সচিব মহিউদ্দিন সরদারকে একাধিকবার ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। উল্লেখ্য তৌফিকা ফুডস অ্যান্ড লাভেলো আইসক্রিমের মোট শেয়ার সংখ্যা ৮ কোটি ৫০ লাখ, যার মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার রয়েছে ৪১ দশমিক ১২ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ১৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার রয়েছে ৪১ শতাংশ।
সর্বশেষ হিসাব বছরে (৩০ জুন,২০২৪) ১০ শতাংশ ক্যাশ এবং ১০ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছে কোম্পানিটি।