দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন সিকিউরিটিজ নিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও কারসাজি করেন। বিদেশিরা বিভিন্ন পোর্টফোলিওতে বড় ধরনের বিনিয়োগ করেন এবং অল্প সময়ে শেয়ার দর বাড়িয়ে টাকা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। তিনি বলেন, আমাদের সার্ভেইল্যান্সের আগের রিপোর্টে সেকেন্ডারি মার্কেটে বিদেশিদের ভূমিকা ভালো আসছে না এবং এখনো তাই দেখতে পাচ্ছি।
গতকাল চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) আয়োজিত পুঁজিবাজারে করোনাভাইরাসের প্রভাব ও উত্তরণের উপায় সম্পর্কিত এক ভার্চুয়াল সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম এসব কথা বলেন। এ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এমসিসিআই) সভাপতি নিহাদ কবীর।
এসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ব্যাপারে পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, যারা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে আসেন, তারা ভালো আছেন। তবে কেউ কেউ নিয়মিত লেনদেন করতে চাচ্ছেন। সার্ভেইল্যান্স রিপোর্টে দেখা গেছে, তারা বড় ধরনের টাকা বিভিন্ন পোর্টফোলিওতে বিনিয়োগ করেন এবং শেয়ার দর বাড়িয়ে অল্প সময়ে বিক্রি করে টাকা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হিসেবে তাদের স্বাগত জানাই এবং আমরা সবধরনের সহযোগিতা করছি। কিন্তু ম্যানিপুলেশনের (কারসাজি) ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান কঠোর।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে এখন বিনিয়োগের সঠিক সময়। তাই ব্রোকারেজ হাউজগুলোকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিষয়টি বুঝানোর জন্য বলব। প্রয়োজনে আপনারা (ব্রোকারেজ হাউজ) রোড-শো আয়োজন করেন, সেখানে আমি যাব। সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, সাংহাইসহ যেসব দেশে বিনিয়োগকারীরা আছেন, সেখানে রোড-শো করেন। আমি প্রেজেন্টেশন দিয়ে তাদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করে নিয়ে আসব।
অনুষ্ঠানে অন্য বক্তারা বলেন, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে ব্যাংকনির্ভর অর্থায়ন ব্যবস্থা থেকে বের হতে হবে, দেশের পুঁজিবাজারকে কার্যকর করতে হবে। অধিক সংখ্যায় মানসম্পন্ন কোম্পানিকে বাজারে আনতে হবে। প্রয়োজনে আইপিও ব্যবস্থা সহজ ও উৎসাহমূলক কর-ছাড় বাড়াতে হবে। তবে কোনো অবস্থাতেই যাতে কেউ অনিয়ম করে পুঁজিবাজার থেকে টাকা তুলে নিয়ে যেতে না পারে, তার প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কেউ অপরাধ করলে দ্রুততম সময়ে এবং কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই মানুষ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে।
বক্তাদের কথা সমর্থন করে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বলেন, আগে আইপিওতে যে ভুলগুলো দেখেছি, সেখানে মেজর ছিল অ্যাকাউন্টিং সংক্রান্ত কাগজপত্রে। এখানে জালিয়াতি করা হয়। কিছুর কোম্পানির ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আইপিও অনুমোদনের সময় পূর্ববর্তী বছরের যে আর্থিক প্রতিবেদন দিয়েছে তা পরের বছর পুরোপুরি পরিবর্তন করছে, অর্থাৎ জালিয়াতি করছে। একটি কোম্পানি যে অবস্থা দেখিয়ে বাজারে আসছে, প্রকৃতপক্ষে কোম্পানিটির অবস্থা তেমন নয়। গত কমিশন সভায় স্টেটমেন্ট জালিয়াতির কারণে একটি কোম্পানিকে জরিমানা করা হয়েছে। এ বিষয়ে কমিশন সজাগ আছে। আইপিও প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য অনলাইনে অনেক কিছু নিয়ে যাচ্ছি।
এসইসির চেয়ারম্যান বলেন, আমরা স্বচ্ছতা ও সুশাসনে জোর দিয়ে কাজ করছি। মাঝে ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ নামক ব্রোকারেজ হাউজের গ্রাহকদের টাকা নিয়ে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তারপর ত্বরিত ব্যবস্থা নিয়ে একটা বার্তা দিয়েছি যে কেউ অপরাধ করে পার পাবে না। দায়িত্ব গ্রহণের সময় পুঁজিবাজারে দিনে ৫০ কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচা হতো, এখন তা ৩০০ কোটি ছাড়িয়েছে। বাজারকে সঠিক পথে আনতে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, আগামী দুই বছরের মধ্যে গুণগত পরিবর্তন দৃশ্যমান হবে। আইটি ব্যবস্থা আধুনিকায়নে বড় ব্যবস্থা আসছে। ব্যাংক খোলা থাকলে যেকোনো অবস্থায় যাতে পুঁজিবাজার খোলা থাকে, সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ফ্লোর প্রাইস একটি প্রতিবন্ধকতা, এটা ঠিক। এটা আমরাও বুঝি। মার্কেটকে ঠিকভাবে মুভ করতে দেওয়া উচিত। এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে কথা বলে যথাশিগগিরই ব্যবস্থা নেব।
সার্ভেইল্যান্স সফটওয়্যারকে আরও উন্নত করা হয়েছে জানিয়ে বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, এখন অনেক কিছুই ধরে ফেলতে পারি। কারা প্লে ও ম্যানিপুলেট করছে তা দেখতে ও বুঝতে পারি। কিছু কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট ইনসাইডার ট্রেডিং করে ম্যানিপুলেট করেন। এগুলো এখন আমাদের সার্ভেইল্যান্সে ধরা পড়ে যায়। আমরা বিভিন্নভাবে এখন এগুলো ধরতে পারি, কারা এগুলো করে বাজারকে প্রভাবিত করছে। সেগুলোকে শাস্তি দিতেই হবে। আমরা সার্ভেইল্যান্স আরও উন্নত করছি।
সিএসইর চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম বলেন, পুঁজিবাজারের উন্নয়নে মানসম্পন্ন কোম্পানির তালিকাভুক্তির বিকল্প নেই। এ জন্য তালিকাভুক্তির আগেই কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনের যথার্থতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি এবং এ উদ্দেশ্য পূরণে এসইসি, স্টক এক্সচেঞ্জ এবং এফআরসি সমন্বয়ে একটি কমিটি করা যেতে পারে। ফ্লোর প্রাইসের কারণে লেনদেন গতি হারিয়েছে। অবস্থা উত্তরণে ফ্লোর প্রাইস থেকে বের হতে এখনই একটি গাইডলাইন করা দরকার জন্য এসইসির প্রতি অনুরোধ জানান।
নিহাদ কবীর বলেন, বিদেশিদের দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের কথা বললে তারা বলেন, তোমার দেশের বাজারে ৪-৫টির বাইরে বিনিয়োগ করার মতো ভালো কোম্পানি নেই। তারা অভিযোগ করেন- আমাদের বাজারে স্বচ্ছতা নেই, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে ভালো নীতি নেই। যতক্ষণ শুধু ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ দেখে নীতি নেওয়া হবে, ততদিন এ বাজার দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করবে না। গত ৫-৬ বছর ধরে লোকসানে থাকা কোম্পানির শেয়ারদর গত সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে, অথচ ভালো কোম্পানি তার শেয়ারের ভালো দাম পায় না। এ অবস্থা বজায় রেখে শেয়ারবাজারের উন্নতি আশা করা দুরূহ।
তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর সংগঠন বিএপিএলসির সভাপতি ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আজম জে. চৌধুরী বলেন, আগামী দিনের অর্থনীতির কথা চিন্তা করলে অর্থায়নের জন্য অবশ্যই ব্যাংকনির্ভরতা কমাতে হবে, পুঁজিবাজারমুখী হতে হবে। কিন্তু তার জন্য এ বাজারের প্রতি সবার আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রয়োজনে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। কেউ অপরাধ করলে দ্রুত শাস্তি দিতে হবে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এমডি ছানাউল হক বলেন, স্বল্পমেয়াদি তহবিল দিয়ে আইসিবিকে বাজার সামাল দিতে বলা হয়, যা সম্ভব নয়। অনেক কোম্পানি আইপিওর টাকা সঠিকভাবে খরচ করে না, তালিকাভুক্ত হয়ে কোম্পানির সংশ্লিষ্টরা শেয়ার কারসাজিতে জড়িয়ে পড়ছেন।
ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আরএফ হোসাইন বলেন, দরপতন ঠেকাতে ফ্লোর প্রাইস চাপিয়ে দিয়ে পুঁজিবাজারকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে। এটা বহাল থাকলে পুঁজিবাজার শেষ হয়ে যাবে। এর কারণে লেনদেন কমে যাওয়ায় ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংক পথে বসার অবস্থায়। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ সেবা জরুরি সেবার অন্তর্ভুক্ত। ভবিষ্যতে কোনো অবস্থাতেই যাতে বাজার বন্ধ না হয়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে।
পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, শেয়ারবাজারের বিদ্যমান সমস্যার কোনোটিই নতুন নয়, অন্তত গত দশ বছরের পুরনো। করোনা পরিস্থিতির কারণে সংকটগুলো বেড়েছে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, দেশের পুঁজিবাজারে গবেষণাধর্মী কাজ খুবই কম হচ্ছে। ডিএসইর ব্রোকারদের সংগঠন ডিবিএ সভাপতি বলেন, বর্তমান দুরবস্থায় কিছু ব্রোকারেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ডিসিসিআইয়ের সভাপতি শামস্্ মাহমুদ, বিল্ডের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম খান, আইসিবির এমডি আবুল হোসেন, সাবেক ব্যাংকার আনিস এ খান, ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশেদুল ইসলাম প্রমুখ।
নিউজ: দেশ রূপান্তর