ড. জাহিদ হোসেন। বাংলাদেশের অর্থনীতির একজন সুযোগ্য ব্যক্তি। দীর্ঘদিন এ সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। তিনি বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ। বিশ্বব্যাংকে যোগ দেওয়ার আগে দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন দিক ও বাজেট নিয়ে সম্প্রতি কথা হয় এ অভিজ্ঞ মানুষের সঙ্গে। কথা বলেন ভবিষ্যত করণীয় বিষয় নিয়ে। বিজনেস আই বিডির প্রতিবেদক মাহমুদ উল্লাহর সঙ্গে কথপোকথনের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য।
বিজনেস আই: মহামারি করোনার কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে অর্থনৈকিত কর্মকাণ্ড। পরিস্থিতি সামাল দিতে নানা ক্ষেত্রে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে সরকার। এ অবস্থায় করোনা পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি কেমন হবে?
ড. জাহিদ হোসেন: যেহেতু সব লকডাউন, মানুষ ঘর থেকে বেরুতে পারছে না, সব স্থবির অবস্থায় রয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই জিডিপি সূচকে একটি বড় আঘাত আসবে। পুরো পৃথিবীর অর্থনৈতিক অবস্থা এই মুহুর্তে শোচনীয়। উৎপাদন অর্থনীতিরই একটি অংশ। আমাদের উৎপাদন একটি বড় ধরনের সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে সেবা ও শিল্প খাত। মানুষ খরচের দিক দিয়ে অনেক সচেতন হয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা ছাড়া খরচ করছে না। বছরের বড় বড় দুটি উৎসবে কোন খরচ হয়নি ও হবেও না। মার্কেট সীমিত আকারে খুলে দেয়া হলেও অনেকে স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে সেখানে যাবে না।
এছাড়া আমাদের রপ্তানি খাতও একটা বড় ধাক্কা খাবে। এরমধ্যেই গার্মেন্ট ব্যবসা ৮০ শতাংশ কমে গেছে। অনেক বিদেশি বায়ার অন্য দেশে চলে যাবে। অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলবে। তৈরি পোশাক খাতে ৮৩ শতাংশ রপ্তানি কমে গেছে। পোশাক খাত ছাড়াও অন্যান্য খাতে রপ্তানি কমে গেছে। ক্ষুদ্র শিল্প, মাঝারি শিল্প, স্বাস্থ্য ও খাদ্য শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পরিবহন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে দেশের অর্থনীতি যে খুব ভালো অবস্থানে থাকবে না, সেটা বলাই যায়।
বিজনেস আই: বিশ্বব্যাংকের জরিপ বলেছে, আমাদের জিডিপি ৩ এর নিচে চলে আসবে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?
ড. জাহিদ হোসেন: বিশ্বব্যাংক যে বলেছে আমাদের জিডিপি ৩ এর নিচে চলে আসবে, তা গত তিনমাসের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেই বলেছে। এখন পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। দেশের প্রবৃদ্ধি নেমে গেছে, রেমিট্যান্স কমে গেছে। কৃষিখাত কিছুটা রক্ষা করা গেলেও পোলট্রি, মৎস, ডেইরি শিল্প ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, মুরগির বাচ্চা মারা যাচ্ছে। সবজি পরিবহন করা যাচ্ছে না। সার্বিকভাবে সব ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই এগুলোর প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে তো পড়বেই।
এছাড়া সেবা খাতের খুচরা ব্যবসা, পাইকারি ব্যবসা, হকার, ভ্যানচালক, রিক্সাচালক সবারই আয় বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে কর্মসংস্থান হারিয়েছেন। গার্মেন্ট থেকে শুরু করে অনেক প্রতিষ্ঠানেই ছাটাই হয়েছে। অর্থনীতির উপর ব্যাপকভাবেই একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিজনেস আই: দেশের অর্থনীতি এবং ব্যবসা বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোর চ্যালেঞ্জ কি রকম?
ড. জাহিদ হোসেন: ব্যাংকগুলোর জন্য এগুলো বাস্তবায়ন অবশ্যই চ্যালেঞ্জ। অনাদায়ী ঋণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ব্যাংকগুলোকে ১৫ হাজার কোটি টাকা নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দিতে হবে। ১৫ হাজার কোটি টাকা সরকারের কাছ থেকে পাবে। গ্রাহকরা নগদ অর্থ ব্যাংকে না রেখে ঘরে রাখছে, ব্যাংক থেকে উঠিয়ে নিচ্ছে। এছাড়াও ব্যাংকগুলো বিভিন্ন আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। তাদের সুদ ও কিস্তি ঠিকমতো আদায় করতে পারবে না, আয় কমে গেছে। এগুলো অবশ্যই ব্যাংকগুলোর উপর চাপ। যেসব ঋণ তারা দিয়েছে সেগুলো ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, ঠিকমতো ফেরত পাওয়া নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।
বিজনেস আই: যেসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা ব্যাংকিং চ্যানেলের আওতায় নেই তাদেরকে কীভাবে সহায়তা করা যায়?
ড. জাহিদ হোসেন: যাদেরকে সরকার সহায়তা দিবে, সেগুলো বাস্তবায়ন করাও সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এগুলো এখনও বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা রয়েছে, এসব জটিলতা দ্রুত সমাধান করাও আমাদেও জন্য চ্যালেঞ্জ।
যারা ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত নেই, অ্যাকাউন্ট নেই, তাদের ব্যাংক চিনে না, তাদেরকে নতুন অ্যাকাউন্ট খোলাতে হবে। এদেরকে চিহ্নিত করা, ঘনঘন মনিটরিং করা অনেক ব্যয় সাপেক্ষ। অথচ ব্যাংকগুলোর আয় এই মুহুর্তে অনেক কমে গেছে। তাই এসব বাস্তবায়ন কিছুটা কঠিনই বটে।
বিজনেস আই: করোনা মোকাবিলায় প্রণোদনা ঘোষণা করেছে সরকার। এছাড়া লকডাউনের কারণে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বেড়েছে। এ সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে আগামী বাজেট কেমন হওয়া উচিৎ বলে মনে করেন?
ড. জাহিদ হোসেন: আগামী বাজেট আগের তুলনায় আরো বাড়াতে হবে। সময়োপযোগী বাজেট হয়তো আমরা পাবো না, তারপরও কোনটা আগে প্রয়োজন এই প্রায়োরিটির উপর ভিত্তি করেই বাজেট তৈরি করা উচিৎ।
স্বাস্থ্য খাতে সবার আগে নজর দেয়া উচিৎ। সাধারণ মানুষ যেন স্বাস্থ্য সুবিধা সহজে গ্রহণ করতে পারে সেই ক্ষমতা বাড়ানো উচিৎ। হাসপাতালগুলোতে কর্মী সংখ্যা, ডাক্তার, নার্স বাড়াতে হবে, প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ভেন্টিলেটর ক্রয় করতে হবে। আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইনের জন্য হাসপাতাল তৈরিতে বড় খরচ রয়েছে। এসব খরচ অর্থের অভাবে যেনো বাধাগ্রস্ত না হয়, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা যেনো না থাকে সেদিকে নজর দিতে হবে। শুধু সরকারের একার উপর নয়, বেসরকারি ও এনজিওসহ সম্মিলিতভাবেই উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। নন কমার্শিয়াল সেক্টরগুলোকে এখানে আমরা কাজে লাগাতে পারি।
যারা ক্ষুধা ও জীবিকার ঝুঁকিতে রয়েছেন, তাদেরকে ত্রাণ সহায়তা খুব বেশি কাজে আসবে না, তাই নগদ সহায়তা দেয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনে প্রত্যেকের বিভিন্ন ধরনের অ্যাকাউন্ট খুলে সাহায্য দেয়া যেতে পারে। আমাদের এখন ৯০ শতাংশ মানুষের ন্যাশনাল আইডি আছে, মোবাইল আছে। তাদেরকে ব্যাংকের আওতায় আনতে হবে। এটা কোন বড় বিষয় হবে না। এই করোনার সময় গার্মেন্ট কর্মীদের ৬ লাখ অ্যাকাউন্ট খুলে বেতন দেয়া হয়েছে তা আমরা দেখেছি, তাই অ্যাকাউন্ট খুলে সবাইকে ব্যাংকের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব।
খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিতে জোর দেয়া উচিৎ। করোনার পর খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক সহায়তার উপর নির্ভর থাকা ঠিক হবে না। কারণ, পুরো পৃথিবীর পরিবহন ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ। সব দেশই নিজস্ব সমস্যায় রয়েছে। তাই নিজেদের খাদ্য উৎপাদন, মজুদ ও বিপণনে জোর দিতে হবে। কৃষিখাত, সবজি, পোলট্রি, মৎস, ডেইরি এগুলোর উৎপাদন, মজুদ ও বিপণন যাতে সঠিকভাবে চলমান থাকতে পারে, কোনভাবে যেনো বাধাগ্রস্ত না হয়, সেসব দিকে নজর দিতে হবে।
এই অবস্থায় শিক্ষা যেনো চালানো যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামে ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করা যেতে পারে। শুধু সরকারের উপর নির্ভর না করে এনজিওগুলোর সহযোগিতাও নেয়া যেতে পারে, তাদের কাজে লাগানো যেতে পারে।
বিজনেস আই: করোনা পরবর্তী সমস্যা মোকাবিলায় কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?
ড. জাহিদ হোসেন: বড় বড় প্রকল্প যেগুলো বন্ধ করলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে সেগুলো চালু রাখতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। অনেক ছোট ছোট প্রকল্প আছে, সেগুলো পরে করলেও চলবে। পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল এরকম বড় প্রকল্পগুলো চালু রেখে ছোটখাতগুলো যেমন বিভিন্ন এলাকার রাস্তা, কালভার্ট নির্মাণ স্থগিত রাখতে হবে। শুধুমাত্র জরুরি সেবা ও প্রকল্পগুলোই সচল রাখা প্রয়োজন। যেগুলোর উপর প্রাইভেট সেক্টরগুলো অর্থ লগ্নী করতে পারে, বা তাদের আগ্রহ রয়েছে সেইসব প্রকল্পগুলোও করা যেতে পারে।
বিজনেস আই: আর্থিক খাত সচল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকগুলোকে বেশকিছু নীতি সহায়তা দিয়েছে। আর কী কী করণীয় আছে?
ড. জাহিদ হোসেন: বিভিন্ন বেসরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকার রিস্ক শেয়ারিং করতে পারে। এসব নিয়ে চুক্তি করে সরকারকে কাজ করতে হবে। কোন ধরনের স্বজনপ্রীতি যেনো না হয় তার জন্য যারা ইতোমধ্যেই ঋণ নিয়েছে তারা যেনো আবার ঋণ না পায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের তালিকা প্রকাশ করে দিতে হবে। কাঠামোগত সমস্যাগুলো কমিয়ে আনতে হবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী থেকে যেসব আর্থিক সুবিধা ও ঋণ পাওয়া যাবে সেগুলো ভালোভাবে কাজে লাগানো নিশ্চিত করতে হবে।